পোস্ট বার দেখা হয়েছে
কদিন থেকেই গীতা দেবীর কাশিটা বেড়েছে,মেয়ে পারমিতা মাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে ডাক্তার বেশ কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। মা আর মেয়ের সংসার পারমিতা একটা প্রাইমারি স্কুলে কাজ করে, সামান্য মাইনে যা পায় মা মেয়েতে কোন রকমে চলে যায়। গীতা দেবীর সবসময় চিন্তা মেয়ের জন্য,মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করে পারমিতা যেন বিয়ে করে নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নেয়, বলে আমি আর কতদিন বেঁচে থাকব তুই যে একলা হয়ে যাবি,পারমিতা মায়ের কথায় কান দেয় না।পারমিতা রোজ সকাল সাতটা বাজলেই বেড়িয়ে পড়ে যাদবপুর এইট বি বাস স্টপেজে সেখান থেকে বাসে করে সোজা হাওড়া স্টেশন তারপরে লোকাল ধরে রোজ উত্তর পাড়া আসে এখানে একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে সে। সকাল দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয় ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথা দিয়ে যে সারাদিন কেটে যায় পারমিতা বুঝতেই পারে না তার মনে হয় এটাই যেন তার সংসার আর ছুটির দিনগুলো যখন স্কুল থাকেনা বাড়িতে সময় কাটতে চায়না কিন্তু সবসময় একটাই চিন্তা তার অসুস্থ মায়ের জন্যে। পারমিতার স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই বিকেল গড়িয়ে যায়। সারাদিনে এই বিকেলের চাটুকু মা আর মেয়ে একসাথে খায়। তারপরেই পারমিতা ব্যস্থ হয়ে পড়ে স্কুলের কাজে। রাত নটা বাজলেই গীতা দেবী রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েন। পারমিতার শুতে শুতে রাত হয়ে যায় এক একদিন রাতে ঘুম আসতে চায় না যত সব পুরনো কথা মনে আসে সেই ছেলেবেলা থেকে যখন বাবা বেঁচে ছিলো, স্কুল থেকে কলেজে তারপর হটাৎ একদিন বাবা চলে গেলো, সেই দূরে তারার দেশে তখন থেকে শুরু হলো পারমিতার যুদ্ধ। অনেক বার ভেবেছে তার একজন সত্যি কারের বন্ধু দরকার কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কেউ তার জীবনে আসেনি যে তার উপর ভরসা করতে পারে। পারমিতার চোখে ঘুম এসে যায় আস্তে আস্তে সব স্মৃতি আবছা হয়ে আসে। আবার সকালে উঠে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেদিন রোজের মতো পারমিতা সকালে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো যাওয়ার সময় মনে করে ডাক্তারের লেখা মায়ের ওষুধের কাগজটা ব্যগে ভরে নিলো ফেরার পথে ওষুধ গুলো কিনে আনতে হবে । ওদিকে প্রায়ই রোজ
সুনীল দাস বাস কন্ডাকটারের সকালে ডিউটি থাকে পারমিতা যে বাসে যায় রোজ তার সাথে দেখা হয়। পারমিতা সুনীলকে দেখে আবাক হয়ে যায় সুনীলের খাকি পোষাকের তলায় যেন একটা অন্য মানুষ লুকিয়ে আছে প্রতিটি যাত্রীদের সাথে কি সুন্দর ব্যবহার করে শিশু আর বয়স্কদের বাস থেকে নামা উঠার সময় হাত ধরে সাহায্য করে। আজ পারমিতার বাড় থেকে বেড়তে একটু দেরি হয়ে গেল। রাতে গীতা দেবীর কাশিটা বেড়ে গিয়েছিল তাই পারমিতাকে রাতটা মায়ের ঘরেই কাটাতে হয়েছে। বাসে উঠে পারমিতা ঠিক করল আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়ের ওষুধ গুলো নিয় আসবে। পারমিতা নিজের ব্যগটা একবার খুলে দেখে নিল ওষুধের কাগটা এনেছে কি না। পারমিতা বাসে উঠেই দেখতে পেল আজ সুনীলের ডিউটি পারমিতার মনটা ভালো হয়ে গেল কেন জানি যেদিন সুনীল থাকে পারমিতার বেশ ভালো লাগে হাওড়া পর্যন্ত এক ঘন্টার রাস্তা যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সুনীলের কথায় ব্যবহারে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় পারমিতা বুঝতেই পারে না।
সুনীল এসে পারমিতাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বাসের ভারাটা নিয়ে গেল। আজ বাসে বেশ ভীড় এতো সকালে মানুষ যে কোথায় যায় পারমিতা একবার ভাবতে থাকে পরেই মনে হয় তার মতো হয়তো সবাই কাজের তাগিদে বেড়িয়ে পড়েছে। আজ গোটা রাস্তায় ভীড় যায়গায় যায়গায় মিছিল বেড়িয়েছে তিলোত্তমার খুনের বিচার চেয়ে। আজ হাওড়া পৌছাতে বেশ দেরি হয়ে গেল বাস থামতেই পারমিতা ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে আর মাত্র দশ মিনিট আছে ব্যন্ডেল লোকালটা ছাড়তে পারমিতা তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালো পারমিতা লোকালে চাপার সাথে সাথেই লোকাল ছেড়ে দিল আর তখনই পারমিতার খেয়াল হয় সাথের ব্যগটা সে তাড়াহুড়োয় বাসে ফেলে এসেছে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। পারমিতার মনটা খারাপ হয়ে যায় মায়ের ঔষুধের কাগটা কিছু টাকা আর তার ট্রেনের মাসিক টিকিট মোবাইল ফোন ব্যগে ছিল। সারাদিন পারমিতার চিন্তার মধ্যে দিয়ে কাটল কি ভাবে মায়ের ওষুধ গুলো কিনবে বুঝতে পারছিল না। মনের ভেতর একটা ছোট্ট আশা যদি কেউ ব্যগটা পেয়ে বাসের কনডাক্টার সুনীলের কাছে জমা দেয় তা হলে ফিরে পাওয়ার একটা আশা আছে। কিন্তু সুনীলের খোঁজ কোথায় পাবে। পারমিতা ঠিক করে বাড়ি ফেরার পথে এইট বি বাস স্টান্ডে অফিসে গিয়ে সুনীলের খোঁজ করবে। পারমিতার জন্য দিনটাই খারাপ ছিল এইট বি স্টপেজে নেমে পারমিতা দেখে এখানে বিরাট ভীড় বিরাট সভা চলছে মানুষ গিজগিজ করছে সবার গলায় একটাই আওয়াজ তিলোত্তমার বিচার চাই। পারমিতা বুঝতে পারে আজ সুনীলের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। পারমিতার চিন্তা আরো বেড়ে যায় বিশেষ করে মায়ের ঔষুধের জন্যে আর মোবাইল ফোন,মাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঔষধ দেওয়া দরকার। পারমিতা একগাদা চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে এসেই মাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পারমিতার ভালো লাগে পারমিতা দেখে মায়ের কাশিটা আর নেই, ঘরে ঢুকতেই গীত দেবী একগাল হেসে বলে
তোর পাঠানো ওষুধ খেয়ে আজ অনেকটা ভালো আছি পারমিতা অবাক হয়ে যায় বলে আমার পাঠান ওষুধ মানে গীতা দেবী বলেন হঁ্যা তুই স্কুল চলে যাওয়ার পরে একটি ছেলে গায়ে বাস কন্ডাকটারের পোষাক ওষুধ ওষুধের বিল আর সাথে তোর ব্যাগটা দিয়ে বলল দিদিমনি এগুলো আপনাকে দিতে বলেছেন আর আপনি ঠিক সময় ওষুধ খেয়ে নেবেন। পারমিতা বুঝতে পারে কে এই ছেলে এ নিশ্চয়ই সুনীল পারমিতার চোখ ওষুধের বিলের দিকে তাকাতে আরো অবাক হয়ে যায় ওষুধের জন্য খরচ হয়েছে সাতশো টাকা আর ব্যাগে ছিল মাত্র পাঁচশো টাকা তার মানে দুশো টাকা বেশি লেগেছে আর মোবাইল ফোনটাও ব্যগের ভেতরে রয়েছে।হ্যা সেদিন পারমিতা বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর সুনীলের চোখে পড়ে পারমিতা যে সিটে বসেছিল সেখানে একটা লেডিস ব্যাগ পড়ে আছে সুনীল ব্যাগটা দেখেই চিনতে পারে এটা পারমিতার ব্যাগ বুঝতে পারে পারমিতা তড়িঘড়ি বাস থেকে নামতে গিয়ে ব্যাগটা ভুলে ফেলে গিয়েছে । সুনীল তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিয়ে রেখে দেয় যাতে চুরি না যায়, সুনীল ব্যাগটা খুলতেই দেখতে পায় কিছু ওষুধের নাম লেখা ডাক্তারের কাগজ সাথে একটা পাঁচশো টাকার নোট মোবাইল ফোন এছাড়াও অনেক কাগজপত্র যার মধ্যে পারমিতার বাড়ির ঠিকানাও রয়েছে। ওষুধের কাগজে গীতা দেবীর নাম ও বয়স লেখা ছিল সুনীল আন্দাজ করে নিশ্চয়ই এটা পারমিতার মা হবে। সুনীল ডিউটি শেষ করে ফিরে সোজা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ গুলো কিনে কাগজে লেখা ঠিকানা চিনে পারমিতার বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে তখন গীতা দেবী একা ছিলেন সুনীল গীতা দেবীর হাতে ওষুধ আর পারমিতার ব্যাগটা দিলে গীতা দেবী সুনীলকে প্রশ্ন করে তুমি কে আর এই জিনিস গুলো কে দিতে বলেছ সুনীল উত্তর দেয় যে পারমিতা দিদিমনি দিতে বলেছে। সুনীলের মুখে পারমিতার নাম আর পারমিতার হাতের ব্যাগটা দেখে গীতা দেবীর বিশ্বাস হয়। মায়ের কথা শুনে পারমিতা বুঝতে পারে পৃথিবীতে এখনো সুনীলের মতো মানুষ আছে যারা পরের উপকার করে চলেছে আর অপরদিকে তিলোত্তমার হত্যা কান্ডের পেছনে রয়েছে আর এক পুরুষ যার শাস্তির দাবিতে মানুষ পথে নেমেছে। পারমিতা চিন্তা করে সনীলের মতো মানুষ আজও আছে বলে আমরা মেয়েরা একলা পথে সুরক্ষিত হয়ে চলতে পারি। মায়ের কথায় পারমিতার হুস আসে গীতা দেবী মেয়েকে বলেন দাঁড়িয়ে রইলি কেনো ভেতরে আয়।পরদিন সকালে পারমিতা নিজের কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয় রোজকার জিনিসের সাথে আজ একখানা রাখি আর দুশো টাকা মনে করে ভরে নেয় সুনীলকে তার টাকাটা ফেরত দিতে হবে যে।
পারমিতার বুক থেকে একটা দির্ঘনিশ্বাস বেড়িয়ে আসে, পারমিতার মনে হয় সুনীলের মতো মানুষ আজও দুনিয়ায় আছে বলে পারমিতার মতো অসহায় মেয়েরা একলা পথে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারে। সুনীল কখন পারমিতার সিটের কাছে চলে এসেছে পারমিতা খেয়াল করেনি সুনীল রোজের মতো পারমিতাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বাসের ভারা চায় পারমিতা ফিরে তাকায় সুনীল তার স্বভাব মতো একগাল হেসে পারমিতাকে জিজ্ঞাসা করে তার ব্যাগ ফেরত পেয়েছে কিনা আর মায়ের শরীর কেমন আছে। পারমিতা কি ভাবে সুনীলকে ধন্যবাদ জানাবে বুঝতে পারে না শুধু বলে ঠিক সময়ে ওষুধটা পেয়ে খুব উপকার হয়েছে মা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে, পারমিতা ব্যাগ থেকে বাস ভারার সাথে দুশ টাকা যোগ করে সুনীলের হাতে দেয় সুনীল টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিতেই পারমিতা সুনীলের হাতে সুন্দর লাল রঙের রাখিটা সুনীলের হাতে বেঁধে দেয় বলে সুনীল আজ থেকে তুমি আমার ছোট ভাই হলে আর আজ যে রাখি পূর্ণিমা সুনীল পারমিতাকে প্রনাম করে। মুহুর্তের মধ্যে গোটা বাস উৎসবে মেতে উঠে আজ বাসে যতো মহিলা যাত্রী ছিল সবাই এক এক করে সুনীলের হাতে রাখি বেঁধে দেয় সুনীলের দুই হাত রাখিতে ভরে যায় সুনীলের দুচৌখ জলে ভরে আসে এতো ভালোবাসা সুনীল জীবনে কোনো দিন পায়নি, বাসের পুরুষ যাত্রীরা সবাই একসাথে চেচিয়ে উঠে সুনীল যুগ যুগ জিও।
0 মন্তব্যসমূহ