পোস্ট বার দেখা হয়েছে
পল্লব মিত্র—একটা নাম, আর একটা চলমান নীরবতা, যার মধ্যে শূন্যতার সঙ্গে জেগে থাকা এক আশ্চর্য অনুভব লুকিয়ে আছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাশ করেছে বছর তিনেক আগে। বন্ধুদের জীবনে এখন ছকবাঁধা গতির রাজপথ—কেউ ব্যাঙ্কের কর্মচারী, কেউ স্কুলশিক্ষক, কেউ বা এক ধাক্কায় সুদূর কানাডার তুষার ঢাকা শহরে। সবাই যার যার মতো করে 'সেটেল্ড'—তারা জীবনের পরিণতির দিকে হাঁটে, আর পল্লব হাঁটে প্রারম্ভের দিকে, উদ্ভিদের গন্ধমাখা পথ ধরে।
সে থাকে কুচবিহারের এক বিস্মৃতপ্রায় দোতলা কাঠের বাড়িতে—যার কাঠে এখনো পুরোনো দিনের অরণ্যস্মৃতি ঘুমিয়ে থাকে, জানালার গরাদে চড়াই ভোর ডাক দেয়, আর পেছনের সরু জংলা পথটা যেন প্রকৃতির নীরব নিমন্ত্রণপত্র, যার প্রতিটি বাঁকে সজনে গাছের নিচে গুনগুন করে ফেরে বাতাস, আর শালিকের একটানা ডাক।
পল্লবের দিন চলে যায় এমন সব ব্যস্ততায়, যেগুলোর কোনো বাজারদর নেই—পাতা গোনার মধ্যে সে খুঁজে ফেরে মৌসুমি ছন্দ, মাটির গন্ধ শুঁকে বোঝে ভেজা পৃথিবীর মনোভাব, আর রোদে রঙ বদলানো শালগাছের ছায়ায় সে আবিষ্কার করে নিজের ছায়াকেও। সে জানে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃশব্দ সৌন্দর্যগুলো কোনো চাকরির বেতন কাঠামোর মধ্যে বাঁধা পড়ে না।
তার সংসার চলে বাবার প্রাক্তন সরকারি চাকরির ক্ষয়িষ্ণু পেনশনের উপর ভর করে। বাবা বেশিরভাগ সময় নীরব থাকেন, সংসারের ব্যাপারে তেমন কথাও বলেন না। হয়ত ভেতরে-ভেতরে বুঝে গেছেন ছেলেটা তার স্বপ্নের কোনো ধার ধারে না, অথচ যে দিকে হেঁটে যাচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট নয়। মা নেই— মারা গেছেন অনেক দিন হলো, ফুসফুসের ব্যাধি আর হাসপাতালের দেয়াল-চাপা একরাশ নৈরাশ্য বুকে জড়িয়ে । আত্মীয় বলতে কেবল দূরের এক পিসিমা—যিনি প্রতি ফোনালাপে যেন গলায় চিনির বদলে চুন মিশিয়ে বলেন, “এই বয়সে না খেয়ে বনে বনে ঘুরে মরছিস মানে? চাকরি করবি না? একদিন তো মাটির সাথেই মিশে যাবি!”
কিন্তু পল্লব বোঝে—সে বনে ঘোরে মরতে নয়, বাঁচতে। এই ঘোরাই তার প্রার্থনা, তার পরিত্রাণ, তার আত্মজীবনী। শহর যেখানে তাকে "অচল" বলে হেয় করেছে, বন সেখানে তাকে আশ্রয় দিয়েছে অপার স্নেহে। অন্যেরা যাকে ভবিষ্যৎহীন বলে, প্রকৃতি তাকে বলে—“তুই আমার সন্ততি, তুই শিকড়ের পথ চিনিস। একদিন সন্ধ্যেবেলা, যখন আকাশের শেষ আলো পাতার উপর ধূসর চাদর ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন তিনজন গ্রাম্য কিশোর ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল, “পল্লবদা... বাঁদরডাঙার জঙ্গলে নতুন রাস্তা কাটছে! জেসিবি ঢুকেছে!”
পল্লব মিত্র থমকে গেল। বাঁদরডাঙা! এই নামটা উচ্চারণ করা মাত্রই তার বুকের মধ্যে কি যেন এক লহমায় আছড়ে পড়ল। বাঁদরডাঙা তার কাছে নিছক কোনো বনভূমি নয়—ওটা ছিল তার কাছে স্বপ্নের পরাগরেণু, এক শতাব্দীবিহীন চরাচর। সে বহুবার গিয়েছে সেখানে—জীবনের কোলাহল এড়িয়ে, নিঝুম দুপুরে বা নির্জন রাত্রে। পুরোনো এক বটগাছের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত করেছে, বাতাসে পাতার ভাঙা মুখ দেখেছে, বৃষ্টি-ভেজা শিউলি ফুলের মতো সাদা বক দেখে বিস্ময়ে আটকে গেছে তার দৃষ্টি। শীতের রাতে ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ ছিল তার প্রার্থনার সুর, গাছের ফাঁকে ফাঁকে পড়া চাঁদের আলোয় সে দেখেছে নিজের বিমূর্ত ছায়া—যা শহরের আয়নায় কখনও ধরা পড়ে না। সেই জায়গাতেই এখন ঢুকেছে জেসিবি? সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটে গেল। ছুটতে ছুটতে তার মনে হলো, যেন বুকের মাঝখানে কেউ থাবা মেরে বলছে—“তোকে ছাড়া আমি আর বাঁচব না!” যখন সে পৌঁছাল, তখন দৃশ্যটা ছিল ভয়ংকর। মাটি খোঁড়া হচ্ছে—সেই পুরোনো অরণ্যভূমি যেন থরথর করে কাঁপছে। বটগাছের গোড়ার দিকে ফাটল ধরেছে, গাছের ডালপালা টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাটির ডেলার ভিতর। একটা দিগন্তজোড়া ধুলোর স্রোত আকাশকে ঢেকে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা একটা শালগাছ যেন কাঁদছে, যদিও গাছের কান্না কেউ শোনে না—শুধু বোঝা যায় তার ছায়া মরে যেতে চাইছে।
পল্লব এগিয়ে গেল, কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো—“আপনারা কী করছেন?”
একজন উজ্জ্বল জ্যাকেট পরা, হেলমেট মাথায়, আধুনিকতার প্রতিনিধি বলে উঠল—“সরকারি প্রজেক্ট। নতুন ইকো-রিসর্ট হবে। রুরাল ট্যুরিজম। ফরেস্ট ভিউ।” তার মুখে কোনো রাগ নেই, বরং এক ধরনের ট্যুরিজম-পলিসির আত্মবিশ্বাস, যেখানে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হলে তাকে কেটে ফেলা যেতে পারে, ফ্লোরিং করা যেতে পারে, কাঁচ দিয়ে ঘেরা যেতে পারে।
পল্লব বলল, “আপনারা জানেন এখানে কয়টা পাখির বাসা আছে? এখানে শেষবার যখন গিয়েছিলাম, আমি ছয়টা ভোঁদড়ের ছানা দেখেছি ঝোপের মধ্যে। এই অরণ্যটা কেবল গাছ নয়, এ হল এক জীবন্ত সংসার। একে কেটে ফেললে এখানকার জীববৈচিত্র্য এক ঝটকায় শেষ হয়ে যাবে।”
ইঞ্জিনিয়ার নির্বিকারভাবে তাকাল, মুখে তাচ্ছিল্যের ছায়া।
“তুমি কি ফরেস্ট অফিসার?”
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে, যেন যুক্তি নয়, পরিচয়ই ন্যায্যতা নির্ধারণ করে।
না, পল্লব ফরেস্ট অফিসার নয়। সে কোনো সরকারী পদে নেই,
সে কেবল একজন প্রেমিক—প্রকৃতি-প্রেমিক। সে বনের ভাষা বোঝে, পাতার নীচে মাটির কান্না অনুভব করে। তাই তার কথার কোনো মূল্য নেই, তার রক্তের উষ্ণতা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আর ঠিক সেজন্যই সে বিপদে পড়ে।
তাকে চোখে চোখ রেখে হেসে বলে একজন শ্রমিক, “এইসব বেশি জ্ঞান দিলে ঠিক খারাপ কিছু হয় না, কিন্তু মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় মানুষ... বনে তো জানোয়ারও থাকে, তাই না?”
সেই মুহূর্তে পল্লবের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। শুধু প্রকৃতি নয়, তার নিজেরও অস্তিত্ব যেন প্রশ্নের মুখে।
সবুজ বাঁচাতে গেলে কে বাঁচাবে সবুজের পাহারাদারকে? পরদিন রাতের নিস্তব্ধতায়, যখন শালপাতার ফাঁক দিয়ে আধখানা চাঁদ মুখ ঢেকে রেখেছিল, তখন হঠাৎ শব্দ হলো দরজার নিচে।
একটা ভাঁজ করা কাগজ। পল্লব কুড়িয়ে নিল।
চিঠিতে মাত্র এক লাইন লেখা— "খুব বেশি ঘোরাঘুরি কোরো না। গাছ বাঁচাতে গেলে কে বাঁচাবে তোকে?"
নিচে একটা আঁচড়ের মতো কালো দাগ—যেন কারও নখে আঁচড়ানো, রাগ নয়, একধরনের প্রতিরোধহীন ঘৃণা। হুমকি—স্পষ্ট, নিপুণ, এবং ভয়ঙ্কর।
শহরে হলে এই চিঠির ছবি তুলে সোজা থানায় যেত। আইন সেখানে কাগজে থাকে, অভিযোগে সাড়া দেয়। কিন্তু এখানে? এখানে থানা অনেক দূর।
পাহাড় ঘেরা অরণ্যগ্রামগুলোতে এমন হুমকির উত্তর দেয় গুজব, অর্বাচীন আতঙ্ক, কিংবা অজ্ঞাত “দুর্ঘটনা”। এখানে প্রকৃতি যেমন নির্জন, তেমনি মানুষের নিষ্ঠুরতাও নিঃশব্দ।
কিন্তু পল্লব থামল না। তার চোখে এই হুমকি ছিল একধরনের স্বীকৃতি—
শত্রুরা বুঝেছে, সে ভয় পাওয়ার লোক নয়। এখন তাকে থামাতে হলে তার পায়ে কাঁটা নয়, বুকে পাথর ফেলতে হবে। সে আরও গভীরে নেমে গেল লড়াইয়ে। ছোট্ট খাতা আর মোবাইল নিয়ে সে দিনে দিনে তথ্য সংগ্রহ শুরু করল—প্রতিটি গাছের উচ্চতা ও জাত চিনে নিচ্ছিল, পুরোনো পাখির বাসার অবস্থান চিহ্নিত করছিল, সন্ধ্যায় সজারুর গতিপথ, জলের ধারে কচ্ছপের ডেরা, এমনকি শেষ তিন মাসে কোন প্রজাপতি কবে কোথায় দেখা গেছে—সবকিছু লিখে রাখছিলেন পল্লব।
গ্রামের বয়স্কদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল—“এই গাছটা কবে থেকে আছে কাকা?”, “এই পুকুরপাড়ে আগে কী কী দেখা যেত?” একটা অরণ্যের ইতিহাস তৈরি করছিল সে—নথিপত্রের মতো নয়, যেন জীবনের দিনলিপি। কোথা থেকে যেন সংগ্রহ করেছিল স্যাটেলাইট ম্যাপ—পুরোনো উপগ্রহ চিত্র আর নতুন কাটাছেঁড়া ছবি মিলিয়ে দেখাতে চাইছিল, কীভাবে গাছের ঘনত্ব কমছে, কীভাবে নদীর গতিপথও পালটে যাচ্ছে। প্রথমদিকে লোকে হাসাহাসি করত। “পল্লবদা তো সবুজের পাগলা! নেশা ধরেছে গাছ নিয়ে, পাখি নিয়ে,”—গ্রামের মোড়ে আড্ডায় ফিসফাস হত।
কিন্তু ধীরে ধীরে, যখন তারা দেখল এই পাগলটিই একমাত্র মুখ, যে জোর গলায় বলছে—“এই বনকে নিধন করা মানে আমাদের হত্যা করা,” তখন তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে গেল।
তার পাশে এসে দাঁড়াল হারাধন, সেই যুবক যে আগে অরণ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল, এখন বলে, “পল্লবদা যা বলবে, তাই করব।”
বিপ্লব, যে টিউবওয়েলে জল তুলে পল্লবকে খাওয়াত, এবার বলল, “আমরা ফোন ক্যামেরায় ভিডিও তুলব, পাখি আর গাছ—সব জিনিস প্রমাণ হিসেবে রাখব।”
তাদের মধ্যে একজন একদিন বলল—“আগে ভাবতাম পল্লবদা অদ্ভুত ধরনের মানুষ, এখন বুঝি উনার ভেতরে একটা সত্যিকারের মানুষ লুকিয়ে আছে।”
এটাই ছিল পল্লবের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। কারণ একা মানুষ কখনও অরণ্য রক্ষা করতে পারে না—তাকে দরকার হয় একজোড়া সহানুভূতির হাত, এক ঝাঁক অচেনা কণ্ঠস্বর, যারা বলে—“তোমার লড়াই আমাদেরও লড়াই।” একদিন ভোরবেলা।
দিগন্তে আলো ফোটেনি তখনও। পাতার গায়ে শিশিরের ফোঁটা, বাতাসে এক অচেনা নূপুরের ছন্দ। পল্লব হাঁটছিল বাঁদরডাঙার ঘন অরণ্য পথে—প্রতিদিনের মতোই, কিন্তু আজ যেন তার পায়ের কাছে ছায়া থেমে গেছে । চারপাশে নিস্তব্ধতা, যেন বনের সকল পাখি, নির্জনতা উধাও হয়ে গেছে। তখনই সে টের পেল গন্ধটা— প্রথমে একটা মিষ্টি তীব্রতা, যেন শালফুল ফোটার মৌসুম।
কিন্তু মুহূর্তেই গন্ধ পালটে গেল—
ধোঁয়ার তাপ, পোড়া পাতার বিষ, পচা রেজিনের সোঁদা ঘ্রাণ। আগুন! অরণ্যের গভীরে কেউ আগুন ধরিয়েছে! পল্লব আর স্থির থাকতে পারল না—তার ভিতরে যেন এক আদিম তাগিদ জেগে উঠল।
সে দৌড়ে গেল আগুনের উৎসের দিকে—শাল, সেগুন, বট, পলাশ—যারা তাকে এতদিন আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের কেউ আজ জ্বলছে। আগুন তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে, আগুনের লেলিহান শিখা সমস্ত গাছগুলো গ্রাস করে নিচ্ছে দুঃস্বপ্নের মতো। বনের স্তব্ধতা ভেঙে এবার শোনা গেল পশুদের চিৎকার—একটা কাঠবেড়ালি গাছ থেকে পড়ে ছুটে পালাল, দূরে শেয়ালের চিৎকার যেন কান্না নয়, আর্তনাদ। পল্লব জানত, সময় নেই। সে দৌড়ে ঝোপ থেকে এক বোতল জল তুলে নিয়ে ছুটল জ্বলন্ত গাছের দিকে। একে একে সে নিজের গায়ে জল ঢালল, ভেজা গামছা জড়াল মাথায়, তার পর ধোঁয়ার দিকে ছুটে গেল, যেন আগুনকে জিজ্ঞাসা করছে—"কী অধিকার আছে তোর, এই বনের উপর?" গাছের ডালপালায় জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল সে, ঝলসানো ডাল দিয়ে আগুন চাপা দিচ্ছিল। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছিল, ফুসফুসে যেন আগুন ঢুকে পড়ছিল । তবুও থামছিল না সে—যেন নিজেকেই আগুনের কাছে উৎসর্গ করে দিয়েছিল। তখনই এক বিকট শব্দ—একটা শুকনো গাছ উপড়ে পড়ল তার ঠিক পাশে। ধোঁয়া ঘনীভূত হয়ে আকাশ ঢেকে ফেলল, অসহনীয় গন্ধ চারপাশ ঘিরে ধরল। পল্লব একটু কেঁপে উঠল।এক পা সামনে বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল।হয়তো শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছিল না, হয়তো ধোঁয়া ঢুকে পড়েছিল শিরায়, হয়তো এক নীরব মৃত্যুদূত এগিয়ে আসছিল । তারপর সে ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ল, অরণ্যের বুকের ভিতর, যেখানে আগুন তখনও তীব্র বেগে জ্বলছিল, আর বাতাসে করে যাচ্ছে যাচ্ছে তার ভেজা জামার গন্ধ—এক প্রেমিকের, যে বৃক্ষের ভালোবাসায় নিজেকে পুড়িয়ে দিল, এক নিবিড় প্রার্থনার মতো। চোখ খুলতেই প্রথম যা তার নজরে আসে, তা মাটির অস্পষ্ট গন্ধ আর বাঁশের চালের সূক্ষ্ম রেখাগুলো। চারপাশে ছিল ঘরের অসংলগ্ন নিস্তব্ধতা—দেয়ালগুলো সূর্যের হালকা কিরণে ঝলমল করছে যেন অস্পষ্ট ইতিহাসের স্মৃতিসৌধ। মাথার কাছে বসে আছেন এক বৃদ্ধা—তার মুখের কুঞ্চিত রেখাগুলো সময়ের গল্প বলে। চটের ব্যাগ কাঁধে ঝুলছে, চোখ দুটো টকটকে দীপ্তিময়, যেন সে অরণ্যের প্রত্যেক গাছের, পাখির, বাতাসের কথা জানে।
বৃদ্ধার অতীব নীরবতার মাঝে কেবল তার কথাগুলো ভেসে এলো—“তুই মরিসনি। বন তোকে বাঁচিয়েছে।”
পল্লব একটু থমকে গেল, তারপর কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কে?”
বৃদ্ধা হাসল, সেই হাসিটা ছিল ধৈর্যের, কঠোর পরিশ্রমের এবং এক দীর্ঘ যাত্রার।
“আমি এই অরণ্যের পুরোনো পাহারাদার। এক সময় আমার বুক ছিলে গভীর সাহস—গাছেদের পাশে দাঁড়ানো ছিল আমার সাধ। আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমার ধর্ম ছিল। আজ তোমার মতো বিরল মানুষদের পথ দেখানো আমার কাজ।”
পল্লব তার চোখে চোখ রেখে বলল,
“আমি... বুঝতে পারছি না... এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব?”
বৃদ্ধার গলায় শান্ত এক সুর, যা অরণ্যের আকাশের মতই গভীর,
“অরণ্যের মতো জীবন্ত- স্বপ্ন আর বাস্তবের মেলবন্ধন। তুই যখন বনের মধ্যে থাকিস তখন স্বপ্নগুলো সত্য হয়ে ওঠে।”
বৃদ্ধার মুখ থেকে ঝরছিল এক অচেনা, আদিম শক্তি—একটা শান্ত কিন্তু অপরিসীম বুদ্ধিমত্তা, যা পল্লবের হৃদয়ে আলো ফোটাল। সে বুঝতে পারল, এই অরণ্য শুধু গাছ আর প্রাণীর স্থান নয়; এখানে আছে এক জীবন্ত ইতিহাস, এক অদৃশ্য আত্মা, যাকে রক্ষা করতে হবে প্রাণপণে।
বৃদ্ধা তাকে হাতে ধরে বলল,
“পল্লব, তুই বনের বন্ধু, আর বনের বন্ধু কখনো একা হয় না। এই অরণ্যের প্রতিটি ডাল, প্রতিটি পাতায় তোর ছায়া লুকিয়ে আছে। এই বনের যুদ্ধে তোর অস্ত্র হবে প্রেম, ধৈর্য আর বিশ্বাস।”
পল্লবের মন যেন ফুলের পাপড়ির মতো খুলে গেল। সে বুঝতে পারল, তার লড়াই কেবল গাছ বাঁচানো নয়, বরং এক বৃহৎ অস্তিত্বের সঙ্গে নিজের সংযোগ গড়ে তোলা— জীবনের সত্যিকারের ছন্দ খুঁজে পাওয়া। বৃদ্ধা তার হাত ধরে এক গোপন অরণ্যের পথ দেখালেন, যা সাধারণ চোখে ধরা দেয় না। সেখানে ঢুকে প্রথম যে শ্বাস পল্লব নেয়, তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—মাটির গভীর সঙ্গীত, পাতার কোমল স্পর্শ আর বাতাসের সোঁদাগন্ধ মেশা শত শত বছরের স্মৃতি। এই অরণ্য এমন গাছের অভয়ারণ্য, যা উপগ্রহের চোখও স্পর্শ করতে পারে না; কারণ গাছগুলো নয়, এরা জীবনের গভীর তৃষ্ণায় জন্ম নেয়, প্রাণের ভাষায় কথা বলে। পল্লবের সামনে ধীরে ধীরে উঠে এল এক গাছ, যার ডালে ঝুলছিল একটি পাখির বাসা—ছোট্ট ছোট্ট ডিম আর এক মায়াময় সুর। গাছের গুঁড়িতে জড়ানো লতার বৃত্ত, যেন গাছের মনের কথা গোপন করে রেখেছে। পাতাগুলো স্পর্শ করলে জলের স্বাদ লাগে, যেন সেই গাছ প্রকৃতির সমস্ত জলরাশি সঞ্চয় করেছে নিজের বুকে। তার পর পল্লবের চোখ পড়ে গেল গাছের পাদদেশে একটি ছোট্ট, পুরনো, অর্ধবিলুপ্ত ডালে লেখা — “এই গাছ পল্লব মিত্রের নামে উৎসর্গিত, যিনি জীবনের চেয়ে সবুজকে বেশি ভালোবেসেছেন।”
পল্লব চমকে উঠে, হাত ছুঁয়ে দেখে, বিশ্বাস করতে পারেনি, কেমন যেন সেই লেখা তার হৃদয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ঢুকে গেল।
“এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো এখনও মরিনি—কীভাবে আমার নাম এমন গভীরে গাঁথা থাকতে পারে?”
বৃদ্ধা ধীরে ধীরে হাসলেন, সেই হাসি ছিল শান্ত, নীরব, যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর আশ্চর্য রোদের রেখা।
“যখন কারো ভালোবাসা প্রকৃতির গভীরে পৌঁছে যায়, তখন সময় তার নাম খোদাই করে রাখে চিরকালীন অরণ্যের ছায়ায়।
তোর প্রাণ যখন গাছেদের শিকড়ের মতো মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল, তখন আর মৃত্যুর কোনো অন্ত নেই; তুই হয়ে গেছিস এই বনের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রতীক।”
পল্লব হাওয়ার গন্ধে মিশে গেল, চোখ বন্ধ করে ভাবল—এই যে অরণ্যের অন্তরে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে, সেই ভালোবাসাই হয়তো তাকে আজকে বাঁচিয়েছিল, আগুনের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। তার জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, এক নতুন ইতিহাসের চলমান সিঁড়ি হিসেবে।
সপ্তাহখানেক পরে, পল্লব যখন গ্রামে ফিরল, তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি।
সে আর আগের পল্লব নয়—যে ছেলেটা একসময় চাকরি খুঁজে না পাওয়ার হতাশায় সময় কাটাত, আজ সে হয়ে উঠেছে প্রকৃতির এক নিঃস্বরূপ যোদ্ধা, এক সত্যিকারের সবুজ-সন্ন্যাসী। তার পা যেখানে পড়ে, সেখানে মাটির গন্ধ যেন নবজীবনের গান গাইতে শুরু করে। গ্রামবাসী তার পরিবর্তন লক্ষ্য করল, চোখে শ্রদ্ধা আর হৃদয়ে আশা জাগল। তার হাতের স্পর্শে গাছ ফিরে পেল নতুন প্রাণের স্পন্দন, তার কণ্ঠে রয়েছে অরণ্যের গম্ভীর ভাষা। ছোটদের সঙ্গে বসে সে বলে—“শুনো, এই পাতাগুলো কথা বলে, তারা আমাদের পরিবেশের সুরক্ষা চায়। নদীও কখনো কখনো কান্না করে, যদি তার জল কমে যায়। আমরা যদি তা বুঝতে পারি, তবে বাঁচাতে পারব আমাদের প্রকৃতিকে।” সংবাদমাধ্যম তার জীবন সংগ্রামের কাহিনী ছাপিয়ে দিল—“একাকী যুবক বন বাঁচাতে ঝাঁপ দিল আগুনে।”
তার নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, কিন্তু পল্লব কোনো খ্যাতি বা প্রচারের আশা করে না।
সে জানে, তার যুদ্ধ এখন শুরু হয়েছে জীবনের নতুন অধ্যায় থেকে—প্রকৃতির জন্য এক অবিচল প্রতিজ্ঞা। সে শুধু চায়, গাছ লাগাতে, মানুষের মনের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে। শিশুদের শেখাতে কীভাবে গাছেদের ছায়ায় শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে বাতাসে বয়ে যাওয়া পাখির গান জীবনের গান শোনায়, আর কীভাবে প্রকৃতির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অস্তিত্বের গভীর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। পল্লবের চোখে আরেকবার সেই অরণ্যের আলো ফুটে ওঠে—একটি নতুন সূর্যের মতো, যা অন্ধকারকে পিছনে রেখে বাঁচার আলো ছড়ায়। সবুজ খুঁজতে গিয়ে পল্লব মিত্র যেটা পেয়েছে, তা ছিল শুধু গাছের ছায়া কিংবা পাতার কোমল ছন্দ নয়—সে খুঁজে পেয়েছিল জীবনের অর্থ, আত্মার এক গভীরতম স্তর।
সমাজ যেখানে তাকে ‘বেকার’, ‘অকার্যকর’ বলে তাচ্ছিল্য করত, যেখানে তার স্বপ্নগুলোকে অবহেলা করা হত, প্রকৃতি তাকে বেছে নিয়েছিল—নিজের একনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে।
কারণ প্রকৃতির ভাষা অন্যরকম, এখানে সংখ্যার ভাষায় মাপা হয় না, না পদবীর অহমিকায়, না পেশার ভিত্তিতে। প্রকৃতি চায় আত্মার গভীর সংযোগ, চায় হৃদয়ের একান্ত প্রেম।
পল্লবের ভালোবাসা, তার অবিচল বিশ্বাস এই সবুজের প্রতি ছিল সেই আমন্ত্রণ, যা সময়কে পেছনে ফেলে চিরকালীন হয়ে ওঠে। সবুজের ভিতরে লুকিয়ে থাকে এক চিরন্তন আহ্বান—
"এসো, আমার ছায়ায় দাঁড়াও, আমি তোমায় জীবন দেবো। আমি তোমার ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে যাবো, তোমার অন্তরকে শান্ত করব, তোমাকে বাঁচানোর পথে শক্তি দেব।"
পল্লব সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল নিজের অন্তর থেকে—সেই অরণ্যের মাঝেই সে আবিষ্কার করল জীবনের এক নতুন ধ্রুবতারা, যা শুধু আলো ছড়ায় না, বরং পথ দেখায়, অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নের উত্তর দেয়। এখানে কেউ একা নয়, কারণ গাছেদের ছায়ায় হাজার হাজার জীবনের গল্প ঘুরে বেড়ায়—একটি গভীর সমঝোতা, এক অন্তর্দৃষ্টির জয়গান।
পল্লব বুঝল, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সে শুধু সবুজ বাঁচাচ্ছে না, সে বাঁচাচ্ছে নিজের প্রাণকেও, মানুষের সেই ভুলে যাওয়া সম্পর্ককেও—যা হয়তো এই আধুনিক জীবনের জঞ্জালে হারিয়ে গিয়েছিল। এভাবেই পল্লব মিত্র হয়ে উঠল প্রকৃতির সেই নিষ্পেষণহীন বন্ধুবর, যিনি বুঝেছেন—সবুজের মাঝেই লুকিয়ে আছে জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। একটা সত্য, যা শুধু দেখা যায় হৃদয়ের চোখে, শোনা যায় নিঃশব্দের ভাষায়, এবং বাঁচানো যায় অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
0 মন্তব্যসমূহ