পোস্ট বার দেখা হয়েছে
নজরুল সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য
এ কে আজাদ
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার এক পরিপূর্ণ ও সচেতন মুখপাত্র । ভারতীয় উপমহাদেশের অনার্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে তিনি যেমন ধারণ করেছিলেন, তেমনি পারিবারিকভাবে ইসলাম ধর্মের ঐতিহ্যেরও ধারক ছিলেন তিনি। ফলে ভারতীয় এবং ইসলাম ধর্মের ভিত্তিভূমি মধ্যএশিয়া তথা আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্য নজরুল-সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ইসলাম ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য অত্যন্ত শিল্পীতরূপ লাভ করেছে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মননে, যার প্রমাণ তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সংগীতের পরতে পরতে জাজ্বল্যমান। ইসলামী বিশ্বাস ও আকিদা, আল্লাহ ও রসূল ভক্তি, ইসলামের ইবাদত সমূহ ও আচার অনুষ্ঠান এবং ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য তাঁর লেখায় বিশালভাবে বর্তমান। ফলশ্রুতিতে কাজী নজরুল ইসলামই বাঙালি মুসলিম-মানসের একমাত্র সচেতন ও উদার প্রতিনিধিরূপে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন এবং তাঁর অবস্থান শত বছরেও এতটুকু ম্লান তো হয়ইনি, বরং কালের ব্যবধানে এই উপমহাদেশের মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা আরও প্রবল হয়েছে। এই যে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম ঐতিহ্যকে নজরুল তাঁর রচনায় ধারণ করেছেন, তার পেছনে তাঁর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। আজন্ম স্বাধীনতার চেতনা লালনকারী এই কবি মুসলিম ঐতিহ্যকে তাঁর সাহত্যিকর্মে বুননের মাধ্যমে পরাধীনতার যাঁতাকল থেকে এদেশকে মুক্ত করতে চেয়েছেন জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে।
ঐতিহ্য বলতে আমরা কি বুঝি? ঐতিহ্য হচ্ছে এমন কিছু যা যুগ যুগ ধরে কোন জনগোষ্ঠির মধ্যে টিকে রয়েছে, এটা হতে পারে কোন অভ্যাস, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা বা এমন কোন স্থাপনা যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। অর্থাৎ ঐতিহ্য বা ট্রাডিশন বলতে পরম্পরাগত কথা, পুরুষানুক্রমিক ধারা, কিংবদন্তি, বিশ্রুতি বা লোক প্রসিদ্ধিকেই বুঝায়।
The Britannica Dictionary (দি ব্রিটানিকা ডিকশনারি) মতে -
১. Tradition is a way of thinking, behaving or doing something that has been used by the people in a particular group, family, society etc. for a long time.
২. Traditions are the stories, beliefs etc. that have been part of the culture of a group of people for a long time.
A.S. Hornbey’s Oxford Advanced Learners’ Dictionary মতে –
Tradition means the passing of beliefs or customs from one generation to the next.
ঐতিহ্যবাদী বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে ইতালীয় দার্শনিক এন্টোনিও গ্রামসি লিখেছেন -
Traditional intellectuals are those who see themselves as autonomous and independent from the ruling social group believing to stand for the truth and reason.
নজরুলের রচনায় একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে মুসলিম ঐতিহ্যের বয়ান। এ বয়ান শুধু বয়ান নয়, এ যেন শক্তির উচ্চারণ। মোটা দাগে মুসলিম ঐতিহ্য নিম্নবর্ণিত উপায়ে নজরুল সাহিত্যে বিদ্যমান আছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়ঃ
বিশ্বাসের ঐতিহ্যঃ
মুসলমানদের যে ধর্মীয় বিশ্বাসের ঐতিহ্য, সে ব্যাপারে পুরোপরি ওয়াকিবহাল ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুসলিমগণ মনে করেন আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি মানুষকে ভালবাসেন ও সব সময় তাদের সাথে থাকেন। আমাদের সুখ-দুঃখের এক মাত্র ত্রাণকর্তা আল্লাহ। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন -
আল্লাহ পরম প্রিযতম মোর আল্লাহ তো দূরে নয়,
নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে সে পরম প্রেমময়।
পূর্ণ পরম সুন্দর সেই আমার পরমপতি
মোর ধ্যান-জ্ঞান-তনুমন প্রাণ, আমার পরমগতি।
[আল্লাহ পরম প্রিয়তম মোর]
আল্লাহ নিরাকারঃ
মুসলিম বিশ্বাসী ঐতিহ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, মুসলিমগণ মনে করেন আল্লাহ নিরাকার। তাঁর আসন আছে আরশে আজীমে, কিন্তু তাঁর আকার বা রূপ কোন মানুষ বা সৃষ্টি-জীবের কাছে অনুমেয় নয়। অন্ধ বধুর উদাহরণ দিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেনঃ
রূপ আছে কি না জানিনা, কেবল মধুর পরশ পাই,
এই দুই আঁখি দিয়া সে অপরূপে কেমনে দেখিতে চাই?
অন্ধ বধু কি বুঝিতে পারে না পতির সোহাগ তার?
দেখিব তাঁহার স্বরূপ কাটিলে আঁখির অন্ধকার।
[আল্লাহ পরম প্রিয়তম মোর]
রসূল (সাঃ) এর প্রতি বিশ্বাসঃ
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে শেষ রসূল হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন এবং পথ প্রদর্শক হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করা মুসলমানদের বিশ্বাসী ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নজরুলের ভাষায়-
ধরার পঙ্কে ফুটিলো গো আজ কোটিদল কোকনদ,
গুঞ্জরি ওঠে বিশ্বমধুপ আসিলো মোহাম্মদ।
...........................................................................
আঁধার নিখিলে এলো আবার আদি প্রাতের সে সম্পদ
নূতন সূর্য্য উদিল ঐ মোহাম্মদ ! মোহম্মদ !
[মরুভাস্কর। প্রথম সর্গঃ অবতরণিকা]
মহানবীর সম্মানে দরুদ ও সালাম পাঠঃ
মুসলিম ঐতিহ্যের একটা বড় অংশ হলো আখেরি নবী মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সম্মানে দরুদ ও সালাম পাঠ করা। কাজী নজরুল ইসলাম সে ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন তাঁর কবিতায়-
উরজ ইয়েমেন নজদ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম -
মেসের ওমান তিহারান স্মরি কাহার বিরাট নাম
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলায়হি সালাম।
............................ ............................
শোন্ দামাম কামান তামাম সামান
নির্ঘোষে কার নাম-
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলায়হি সালাম
আজ বেদুইন তার ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া
ছুঁড়ে ফেলে বল্লাম
পড়ে সাল্লাল্লাহু আলায়হি সালাম।
[ ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দহম (আবির্ভাব)]
ত্রাণকর্তা মুহাম্মদ (সাঃ)
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মুসলিমগণ তাদের পথ প্রদর্শক ও ত্রাণকর্তা মনে করে থাকেন। তারা মনে করেন মহানবী (সাঃ) মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট থেকে মানব মুক্তির বাণী পবিত্র কুরআনকে সাথে নিয়ে এসেছেন এবং কুরআনের শিক্ষা নিয়ে মানবজাতিকে পথ প্রদর্শন করেন। তাঁর পথে চললেই কেবল মানুষ ইহকালে শান্তি লাভ করতে পারবে এবং পরকালে পাবে মুক্তি। তাঁর দেখানো পথে চলার মাধ্যমে আশাহত মানুষ পাবে সুখের সন্ধান, বেদনায় পাবে স্বস্তির নিঃশ্বাস। পাপী-তাপী পাবে পাপ থেকে মুক্তি। কিয়ামতের দিন কঠিন বিপদের সময় তিনিই শাফায়াতের কান্ডারী। নজরুল লিখেছেন-
ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর
বদনসিব আয়, আয় গুনাহগার, নতুন করে সওদাগর ।
আলকুরআনের জাহাজ বোঝাই হিরা মুক্তা পান্নাতে
লুটে নে রে, লুটে নে সব, ভরে তোল্ তোর শূন্য ঘর।
কালেমার ঐ কানাকড়ির বদলে দেয় এই বণিক
শাফায়েতের সাত রাজার ধন, কে নিবি আয় ত্বরা কর।
............................................
নামে মোবারক মোহাম্মদ, পুঁজি আল্লাহু আকবর।
[ গানঃ ইসলামের ঐ সওদা লয়ে ]
কাবা ঘর এবং রসূল (সাঃ) এর রওজার প্রতি ভক্তিঃ
মুসলমানদের নিকট মক্কা নগরী এক প্রগাঢ় আবেগ জড়িত ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থান। এই নগরীতেই পবিত্র কাবা ঘর অবস্থিত। এই ঘরকেই মুসলিমগণ মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘর বা বায়তুল্লাহ মনে করে থাকেন। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি এবাদতের মধ্যে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করা হয় এই ঘরকে ঘিরেই। এই পবিত্র ঘরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে মুসলমানদের হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। এই ঘরের চার পাশে প্রদক্ষিণ করতে আর ইবাদত বন্দেগী করতে সারা বিশ্বের হাজার হাজার মুসলিম প্রতিবছর হজ্বব্রত পালন করতে আসেন, পাক-পবিত্র হতে আসেন এই মক্কা নগরীতে। প্রসঙ্গতঃ এই মক্কা নগরীতেই কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। কাবা ঘর যে মক্কা নগরীতে অবস্থিত, তার পার্শ্ববর্তী শহরের নাম মদিনা, যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম কল্যাণমূখী ইসলামী রাষ্ট্র যা এখনও সারা বিশ্বের মুসমানদের কাছে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মডেল হিসেবে আদর্শ হয়ে আছে।
৬৩৩ খ্রীঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মৃত্যুবরণ করলে এই মদীনা শহরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নববীর পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই রওজা মোবারক জিয়ারত করা মুসলমানদের নিকট একটি বিশেষ আবেগের পবিত্র বিষয় বটে। এই রওজা মোবারক বিশ^মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অমূল্য সম্পদ। মুসলিম সভ্যতার এই ঐতিহ্য লালন করতেন কাজী নজরুল ইসলামও। সে আবেগের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর রচনায়ঃ
বক্ষে আমার কাবার ছবিচক্ষে মোহাম্মদ রসূল
শিরোপরি মোর খোদার আরশ গাই তার পথে বেভুল।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. . ..
আমার মনের মসজিদে দেয় আজান হাজার মুয়াজ্জিন,
প্রাণের লওহে কোরআন লেখা রুহ্ পড়ে তা রাত্রিদিন।
খাতুনে জিন্নাত মা আমার, হাাসান হোসেন মাথার জেল,
ভয় করি না রোজ কেয়ামত পুল সিরাতের কঠিন পুল ।।
তিনি আরও লিখেছেন -
দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে
বেহুঁশ হয়ে চলেছি যেন কেঁদে কেঁদে কাবার পথে।
হায় গো খোদা কেন মোরে
পাঠাইলে কেন কাঙাল করে
যেতে নারি প্রিয় নবীর মাজার শরীফ জিয়ারতে
আল্লাহ, রসূল, কুরআন, ইমান ও আখিরাতঃ
মুসলমানদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাস যে - মহান সৃষ্টিকর্তাকে যে ব্যক্তি পেয়েছে, তার আর কোন ভয় নেই। তার জীবন স্বার্থক হয়ে গেছে। তাঁর প্রেরিত রসূল (সাঃ) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, যিনি মানব জগৎকে সঠিক পথের দিশা প্রদান করেছেন। রসূলের আদর্শ ধারণ করতে পারলে এবং কুরআনের আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারলে ইহ জগতের মানুষ যেমন শান্তি লাভ করতে পারবে, তেমনি পরজগতেও মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারবে।
একটি গানে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়
আমার নবী মুহাম্মদ যাঁহার তারিফ জগৎময়।
আমার কিসের শঙ্কা/ কোরআন আমার ডঙ্কা
ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়।
কালেমা আমার তাবিজ তৌহিদ আমার মুর্শিদ
ইমান আমার বর্ম, হেলাল আমার খুর্র্শিদ
আল্লাহু আকবার ধ্বনি/ আমার জিহাদ বাণী
আখের মোকাম ফেরদৌস খোদার আশর যেথায় রয়।
(আল্লাহ আমার প্রভু .................. নাহি ভয়।।)
আল্লাহকে পাইতে রসূলের মাধ্যমে যেতে হয়ঃ
মুসলিম বিশ^াসের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হলো- আল্লাহকে পাইতে হলে রসূল(সাঃ)কে ভালবাসতে হবে এবং তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরেই হাঁটতে হবে। তাঁর প্রদর্শিত পথই পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহ নির্দেশিত পথ। কাজী নজরুল ইসলাম একটি গানে লিখেছেন-
আল্লাহকে যে পাইতে আয় হজরতকে ভালবেসে
আরশ কুরছি লওহ কালাম, না চাহিতেই পেয়েছে সে।
রসুল নামের রশি ধরে যেতে হবে খোদার ঘরে
নদী তরঙ্গে যে পরেছে ভাই, দাবিয়াতে সে আপনি মেশে।
...................................................
এই দুনিয়ায় দিবা রাতি ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী
তুই যা চাস্ তাই পাবিরে ভাই আহমদ চান যদি হেসে ।
মানুষের অধিকার/মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান হীনতাঃ
ইসলামী জীবন ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ঐতিহ্য হলো- ইসলামে কোন জাতি ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ নাই। ভেদাভেদ নেই আমিষ ও ফকিরে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করা ও মুসলমানদের বহুদিনের ঐতিহ্য। ধনী গরীবের ব্যবধানহীনতা, সামাজিক সম অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ঈদের শিক্ষা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
আজি আরাফাত-ময়দান পাতা গাঁয়ে গাঁয়ে
কোলাকুলি করে বাদশা ফকিরে ভায়ে ভায়ে।
...................................................
আজি ইসলামী ডঙ্কা গরজে করি জাহান
নাই বড় ছোট সকল মানুষ এক সমান।
...................................................
ইসলাম বলে- সকলের তরে মোরা সবাই
সুখ দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের
কারও আঁখিজলে, কারও ঝাড়ে ফিরে জ্বলিবে দ্বীপ
দু’জনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের। [ ঈদ মোবারক ]
সাম্য-প্রীতিঃ
সাম্য বিষয়ে ‘আজাদ’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন-
অন্যেরে দাস করিতে কিংবা নিজে দাস হতে ওরে
আসেনিক দুনিয়ায় মুসলিম ভুলিলি কেমন করে?
ভাঙ্গিতে সকল কারাগার, সব বন্ধন ভয় লাজ
এলো যে কোরান, এলেন যে নবী, ভুলিলি সে সব আজ? [ আজাদ ]
“আমরা সেই সে জাতি’’ শিরোনামের গানে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
ধর্ম্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি
আমরা সেই সে জাতি।
........................................................
আমিরে-ফকিরে ভেদ নাই, সবে ভাই সব এক সাথী
আমরা সেই সে জাতি।
দান খয়রাতঃ
প্রত্যেক সম্পদশালী লোকের উপরে তার গচ্ছিত সম্পদের উপরে শতকরা ২.৫০% হারে জাকাত প্রদান করা ফরত। গরীবে অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই বিধান ইসলামের মৌলিক সামজিক ঐতিহ্য হিসেবে বহু বছর ধরে পালন করে আসছে মুসলিম জাতি। জাকাতের পাশাপাশি, সাধারণ দান খয়রাত করাও মুসলিম ঐতিহ্যেরই অংশ। ধনীদের সম্পাদে গরীবের অধিকার আল্লাহ নিশ্চিত করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী দান খয়রাত করা ইসলামের একটি অর্থনৈতিক বিধানও বটে। তবে গরীব মানুষকে তার অধিকার বুঝিয়ে কেউ সম্পদ ভোগ করতে চাইলে তাতে ইসলামের কোন বাধা নেই। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
ঈদ-আল্-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান
ক্ষধার অন্ন হোক তোমার,
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষাতুরের হিস্যা আছে ও পেয়ালাতে
দিয়ে কর ভোগ বীর দেদার। [ ঈদ মোবারক ]
নারীমুক্তিঃ
ইসলামের অত্যন্ত চমৎকারিত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হলো নারীদের সম্মান প্রদর্শন ও নারীর অধিকার সংরক্ষণ। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে নারীদের কোন মর্যাদা ছিল না। নারী সন্তান কারও ঘরে জন্মগ্রহণ করলে সে পরিবার লজ্জা বোধ করত, অসম্মান মনে করত। এমন কি নারী সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার নির্মম ইতিহাসও অস্বাভাবিক ছিল না সে যুগে। তারা পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়া তো দূরের কথা, নারীদেরকে হেনস্থা করার হত প্রতিনিয়ত। নারীরা কেবল ভোগের সামগ্রী বৈত আর কিছু ছিল না সে যুগে। এমনই এক অন্ধকার যুগে আগমণ ঘটে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি নিলেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত মহান আল্লাহ পাকের বাণী পবিত্র কুরআন শরীফের মাধ্যমে প্রচারিত হলো নারীমুক্তির সনদ। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো পৈত্রিক সম্পদে। নারীরা অধিকার পেল তার স্বামীর সম্পদে, ভাইয়ের সম্পত্তিতে, মায়ের সম্পদে, এমনকি সন্তানের সম্পদেও। নারীরা পেল মায়ের মর্যাদা। ঘোষিত হলো- মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত। তারপর থেকেই নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও অধিকার প্রদান হয়ে গেল মুসলিম ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কাজী নজরুল ইসলাম সেই মহান মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখলেন-
নারীরে প্রথম দিয়াছি নরসম অধিকার
মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার
আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশার বাতি
আমরা সেই সে জাতি।
জাকাতঃ
ইসলামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় বিচার, সুষম সম্পদ বন্টন নীতিমালার মূলমন্ত্র হলো জাকাত পদ্ধতি। মুসলমানগণ যুগের পর যুগ ধরে এই জাকাত ব্যবস্থাকে ঐতিহ্যবাহী প্রথা হিসেবে পালন করে আসছে। এ বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন গান-
দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত
তোর দিল খুলবে পরে, আগে খুলুক হাত
দেখ পাক কোরান, শোন নবীজীর ফরমান
ভোগের তরে দুনিয়ায় আসেনি মুসলমান।
......................................
তোর দর দালানে কাঁদে ভূখা হাজারও মুসলিম
আছে দৌলতে তোর তাদেরও ভাগ- বলেছেন রহীম
বলেছেন রহমানুর রহীম, বলেছেন রাসুলে করীম।
কালেমা, নামাজ রোজা, হজ¦, যাকাতঃ
মুসলিম বিশ্বাসী ঐতিহ্যের সূলমন্ত্রই হলো- কালেমা, নামাজ রোজাসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদত সমূহের পালন। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
নামাজ পড়, রোজা রাখ, কলমা পড় ভাই
তোর আখেরে কাজ করে নে, সময় যে আর নাই।
সম্বল যার আছে হাতে
হজ্বের তরে যা কাবাতে
জাকাত নিয়ে বিনিময়ে শাফায়াত যে পাই।
আল কোরআনঃ
ইসলামী আক্বিদার বীজমন্ত্র যে মহাগ্রন্থে বাণীবদ্ধ আছে, সে গ্রন্থ আসমান থেকে নাজিল হয়েছে- এমন বিশ্বাসের ঐতিহ্য বুকে ধারণ করেন মুসলিমসগণ। মুসলমান মাত্রই এ কথা বিশ্বাস করে যে, এই কুরআনের মাঝেই লুকিয়ে আছে মহান স্রষ্টার মাহাত্ম। এই কুরআনে বর্ণিত জীবন বিধানকে মেনে চলে মানুষ পেতে পারে মহা সুখের সন্ধান। পেতে পারে মহান রবের সান্নিধ্য। মহান স্রষ্টা থাকেন সপ্তম আসমানে তাঁর শাহী আরশে আজিমে। চন্দ্র সূর্য ও তারকা খচিত নীল আসমানকে দেখে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে মনে হয়েছে তিনি যেন আল কোরআনকে খুঁজে পেয়েছেন। একজন মুমিন মুসলমান মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন সেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন রক্ষিত ছিল মহাপবিত্র আরশে আজিমের সাথে সংযুক্ত পবিত্র লওহে মাহফুজে। একজন আক্বিদাসম্পন্ন মানুষের মনের সেই গভীর প্রকাশ যেন কাজী নজরুল ইসলামের গানে-
জরিন হরফে লেখা, রূপালী হরফে লেখা
আসমানের কোরআন, নীল আসমানের কুরআন
লেখা তারায় তারায় খোদার কালাম
পড়রে মুসলমান।
সেথা ঈদের চাঁদে লেখা
মোহাম্মাদের নামের রেখা
..........................
খোদার আরশ লুকিয়ে আছে ঐ কুরআনের মাঝে
খোঁজে ফকির দরবেশ সেই আরশ সকাল সাঁঝে।
খোদার দীদার চাস রে যদি
পড় এ কুরআন নিরবধি
খোদার নূরের রওশনীতে রাঙ্রে দেহ প্রাণ।
ঈদ উৎসবঃ
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা হলো মুসলিম সামজিক জীবনে সব থকে বহুল উৎসবমুখর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দ্বিতীয় হিজরী থেকে স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে এই উৎসব দুটি অত্যন্ত আনন্দমূখর পরিবেশে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে মুসলিমবিশ্ব পালন করে থাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব দু’টি। মুসলিম ঐতিহ্যের আচার অনুষ্ঠান কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাঁর ঈদ বিষয়ক প্রতিটি লেখাতেই মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা প্রকাশিত হয়েছে পূর্ণভাবে। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
পথে পথে আজ হাঁকিব বন্ধু
ঈদ মোবারক আসসালাম
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল কালাম।
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ।
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা-রে।
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে-
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ।।
ঈদের দিনের আনন্দ উৎসবের যে ঐতিহ্য বহুদিন ধরে মুসলিম সমাজ ধারণ করে, তার প্রকাশ নজরুলের কবিতায়:
আজ ছেলেমেয়ে কাঁদে না কো, তারা ক্ষুধাতৃষা ভুলিয়াছে
কাল সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদের নিশান যে দুলিয়াছে।
শিরনি পাইবে, ফিরনী খাইবে, আনিয়াছে জামবাটি,
মনের খুশীর ঈদগাহে পাতিয়াছে কে শীতল পাটি।
[জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ]
কুরবানী:
ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এক মহান ব্রত নিয়ে বহুদিন ধরে মুসলমানগণ পালন করে আসছে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঈদুল আজহা বা কুরবানী। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) এর কুরবানী দেবার ঘটনাকে স্মরণ করে এবং আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যে মুসলিমগণ হালাল পশু কুরবানী করে থাকেন প্রতি বছর এবং এই কুরবানীর গোস্ত আত্মীয় স্বজন ও গরীব মানুষদের মাঝে কল্যাণার্থে বিতরণ করে থাকেন। এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কুরবানীর ঐতিহ্যকে ধারণ করতে গিয়ে মুসলিম জাগরণের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন তিনিঃ -
দাও কোরবানী জান ও মাল
বেহেস্ত তোমার কর হালাল,
..............................
কোরবানী দাও প্রিয় বিভব
‘জবীহুল্লাহ’ ছেলেরা হোক
যাক সব কিছু সত্য রোক
মাহাজেরা হোক মায়েরা সব। [শহীদি ঈদ]
ঈদুল ফিতরঃ
ঈদুল ফিতরের মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন -
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ
তোর সোনা দানা বালা খানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত মূর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিঁদ।
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন, হাত মিলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরীদ।
[ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ ]
আজানঃ
মুসলিম ঐতিহ্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাত্যহিক জীবনে রোদ বৃষ্টি বাতাসের মতই জড়িয়ে থাকা বিষয় হলো আজান। এ বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
বুঝেও বুঝিনা কো- এযে এক এক পা করে
পলে পলে গোরের দিকেই যাচ্ছি ক্রমে সরে,
শুনি তখন আজানের কি বজ্র গভীর স্বর-
আল্লাহু আকবর - আল্লাহু আকবর।
........................................
ও গো পাগল উদাস করা পবিত্র আহŸান,
কেমন করে ভক্তি ক্ষীরে ডুবিয়ে দাও জান।
বক্ষে কী সে পাগল-ঝোরার উজান বয়ে যায়!
ভোর বেলাকার আবছায়া আর সাঁঝের ¤øানিমায়;
দুপুর বেলার রোদ বৈকালের পুরবী।
রাতের ডাকে ছড়াও বিশ্বে কতই সুরভী।
মাটির মানুষ প্রভুর কাজে পাছে করি হেলা-
তাই তো তুমি ডেকে ডেকে জাগাও পাঁচই বেলা। [আজান]
মুসলিম আচারঃ
সকল কাজে আল্লাহকে স্মরণ করা মুসলমানদের অন্যমত সাংস্কৃতকি ঐতিহ্য। প্রত্যেক কাজের শুরুতে আল্লাহর নাম স্মরণ করা এবং তাঁকে ভরসা করা মুমিন মুসলমানের ইমানী দায়িত্ব। আল্লাহর নাম স্মরণের মাধ্যমে ভোরে ঘুম থেকে জাগরণ এবং সারা দিনের কাজের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মুসলমানদের প্রাত্যহিক আচার। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
আল্লাহর লইয়া বান্দা ফজরে উঠিও,
আল্লাহ নামের আহলাদে ভাই ফুলের মত ফুটিও।
কাজে তোমার যাইও বান্দা আল্লাহরই নাম লইয়া,
ঐ নামের গুণে কাজের ভার যাইবে হাল্কা হইয়া।
শুনলে আজান কাজ ফেলিয়া মসজিদে শির লুটিও।
আল্লাহর নাম লইয়া রে ভাই কইরো খানাপিনা,
হাটে মাঠে যাইও না ভাই আল্লাহরই নাম বিনা।
পরিশেষে, এ কথা বলা যায় যে- কাজী নজরুল ইসলাম হলেন মুসলিম ঐতিহ্যের সফল চিত্রকর, যাঁর রচনায় মুসলিম জীবনের ঐতিহ্য অত্যন্ত সুনিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। সে চিত্রায়নে তিনি যুক্ত করেছেন কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক মুসলমানদের প্রকৃত আকিদা ও বিশ্বাস, যে কারণে তিনি মুসলিম সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে চলেছেন যুগের পরে যুগ ধরে।
[লেখকঃ- এ কে আজাদ, বি এ (অনার্স), এম এ (ইংরেজী)। কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। মোবাইল নং ০১৭১৪-৫১৩৫০৪, ইমেইলঃ akazadkobi@gmail.com ]
গ্রন্থ সহায়িকাঃ
১. নজরুল ইসলামঃ ইসলামী কবিতা। প্রকাশনায়- ইসলামকি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
২. নজরুলের ইসলামী গান। প্রকাশনায়- কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
৩. নজরুল রচনাবলী ৩য় ও ৮ম খণ্ড। প্রকাশনায়- কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
0 মন্তব্যসমূহ