পোস্ট বার দেখা হয়েছে
(লেখক: মো: হাসিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও পিএইডি গবেষক)
দরিয়ার দেশে দারিদ্যতা নয় অর্থাৎ নদীমাতৃক দেশে দারিদ্রতা থাকতে পারে না; কেননা নদী হবে কৃষিকাজে সেচের উৎস, নদী হবে মাছ চাষের আধার, নদী যোগাযোগের পথ সহজলভ্য ও সুগোম করে, নদী পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে নদীকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশে দারিদ্রতা থাকতে পারে না। বিশ্ব নদী দিবস-এর যাত্রা শুরু হ্য় ১৯৮০ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আনুষ্ঠানিকতায় বিসি রিভারস ডে পালন হিসেবে যা এখন প্রতিবছর ২৫ সেপ্টেম্বর পালিত হয়।নদী রক্ষায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ব নদী দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে নদী রক্ষায় অর্থাৎ নদী দুষণ-দখলের সচেতন বৃদ্ধি করা। পরিবেশ রক্ষায় নদী হচ্ছে পৃথিবীর আর্শিবাদ। প্রতি বছর্ই দিবসটি পালন হলেও আমাদের দেশের নদনদীগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুন। নদী দূষণে মাত্রা অত্যধিক এবং দখল হয়ে গেছে বহু নদী। গত ৫০ বছরে দেশের নদ-নদীর সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। ইতিহাস ও বই হতে জানা যায় আমাদের দেশে ৭০০ টি নদী ছিলো।বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর গবেষণা মতে নদীর সংখ্যা ৪০৫ টি । তবে তালিকায় থাকা নদীগুলোর মধ্যে দখল-দূষণে অনেক নদীর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যা, অতিবৃষ্টি, নদীভাংগন এদেশে প্রায় প্রতিবছরই হয়ে থাকে। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের প্রায় 20 শতাংশ ভূখন্ড বন্যা কবলিত হয়ে থাকে। অতিবৃষ্টি বা ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখন্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। গড়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রধান প্রধান নদীসমূহে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ সৃষ্টি হয় অতি বৃষ্টিজনিত কারণে, দেশের আভ্যন্তরিন নদীসমূহের নিয়মিত ড্রেজিং এর অভাব, পুকুর, খাল-বিল-ডোবাসমূহ ভরাট করার ফলে এবং পার্শ্ববর্তি দেশের নদীসমূহের পানি বৃদ্ধির প্রবাহের কারনে। পার্শ্ববর্তি দেশে বন্যা হলে সেখানকার বাধসমূহ নির্দ্ধিধায় খুলে দেওয়া হয় সেখানে অবশ্যই দ্বিপার্খিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: মৌসুমি বন্যা, আকর্ষিক বন্যা, জোয়ারসৃষ্ট বন্যা। ১৯৮৮ আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অস্বাভবিক বন্যায় সারাদেশে ভয়ংকর বিপর্যয় হয়। সে সময়ে সমগ্র দেশের ৬০% এরও অধিক এলাকা প্লাবিত হয় এবং জলাবদ্ধতা সৃস্টি হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরও তখন ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়।
এবছরও পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ভয়াবহ বন্যায় বানভাসি মানুষের দূর্বিসহ জীবন যাপন করতে হয়েছে। উজানের ঢলে বাড়িঘর, ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যাওয়া ও নদী ভাংগনের পর লাখ লাখ মানুষ ঘরের চালে, নৌকায় অথবা বেড়িবাঁধ ও উঁচু রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশাপাশি পোল্ট্রি খামার, ছাগল, ভেড়া, গৃহপালিত গবাদিপশুরাও বিপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা-যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, সুরমা-কুশিয়ারা, পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যার পানি মধ্য-নিম্নাঞ্চলে ধাবিত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
বন্যাকবলিত স্থানসমূহের পূর্বের তথ্য-উপাত্ত সsগ্রহ করে বন্যা বা অতি বৃষ্টি কবলিত স্থানসমূহকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী জোনিং করে জনগনকে সচেতন করতে হবে, তাহলে বন্যার পানি অন্ত:ত বাড়ী-ঘরে প্রবেশ করবে ক্ষতি করবে না। খাল-বিল, পুকুর এবং নদী খনন ও পুন:খনন করে অধিক পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পারলে নদীর পানি বৃদ্ধি ও অতিবৃষ্টির জন্য বন্যার প্রকোপে পড়তে হবে না। অপরদিকে খালে-বিলে, নদীতে অধিক পরিমাণে পানি সংরক্ষণের করতে পারলে শীত মৌসুমে কৃষিকাজে পানির প্রয়োজন মেটানো সহজ হবে। এই জন্য প্রতি বছরই বন্যার সমস্যা সমাধানের জন্য নদীতে ড্রেজিং ও খাল খননের উপর বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু সঠিক কৌশল ব্যবহার না করার ফলে বাঁধের দু’পাশে বৃষ্টির পানি জমে তীরবর্তী মানুষের কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করে।
এক রিপোর্টে দেখাযায়, পদ্মা নদীতে ভাঙনের ফলে রাজবাড়ীর সদর উপজেলার বড়চর বেনীন এলাকায় পদ্মার তীররক্ষা ব্লকের ৮৭ মিটার ধসে গেছে। ওই এলাকার অন্তত ৩ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে। সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের বড়চর বেনীনগর, কাকিলাদাইর, মহাদেবপুর গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। বড়চর বেনীনগর গ্রামে তীররক্ষা প্রকল্পের ব্লক ধসে গেছে। ব্লকের পশ্চিমদিকে বালুর টিউবব্যাগ ফেলা হয়েছে (সূত্র: দি ডেইলি স্টার)। দেখাযায়, সিমেন্টের ব্লক দিয়ে তৈরী বাঁধ সচারচর পানির স্রোতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ব্লকগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে অতি সহজেই নদীতে গড়িয়ে পড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশে সিমেন্টের ব্লক জমাপড়ে নদীতে ভরাট শুরু হয় এবং নদীতে পলিমাটি বৃদ্ধি পায় যার জন্য নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে নদীর পানি সামান্য বৃদ্ধি পেলে ও অতিবৃস্টি হলে নদীর তীরবর্তি গ্রামে বন্যা দেখা দেয় ও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।এই কারণে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। কারন সিমেন্টের ব্লক দিয়ে নদী ভরাট হলে ভবিষতে নদীতে ড্রেজিং করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই, সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ না করে সষ্টভূজ আকৃতির ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে বাঁধ নির্মান করলে ব্লকগুলো একে অপরের সাথে আকড়ে থাকবে ফলে ব্লকগুলি নদীতে গড়িয়ে পড়বে না। দেখাযায়, প্রতি বছরই সিমেন্টের ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মান করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় কিন্তু তা কোন কাজে লাগে না। সষ্টভূজ আকৃতির ডিজাইনের ব্লক দিয়ে নদী ভাংগন রোধ করলে একবার খরচের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে। স্থায়ীভাবে নদীভাংগন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাধ নির্মাণ করা অতি প্রয়োজন। কারন নদী ভাঙন না হলে নদী তীরবর্তি গ্রামগুলি বন্যা প্লাবিত হবে না, জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি কমে আসবে, সেইসাথে গবাদি পশু-পাখিও রক্ষা পাবে।
নদী ভাংগনে পৈত্রিক ভীটা-বাড়ি, ফসলের জমি বিলিন হয়ে মানুষ হয়ে পড়ে সর্বহারা-শেকড় ছেড়া, এর চেয়ে দু:খজনক ও হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে? বানভাসী মানুষেরা সহায়-সম্বল হারিয়ে জীবন যাপনের জন্য উচু রাস্তায় কিংবা বাধের উপর আশ্রয় নিয়ে দূর্বিসহ দিন কাটায়। নদী ভাংগনের মতো দূর্যোগ মোকাবেলায় র্দীঘমেয়াদি ও স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। তীব্র নদীভাংগন এলাকার পূর্ব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নদীভাংগন এলাকাগুলোতে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাধ নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই বাধ নির্মাণ করতে হবে। ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাধ নির্মাণ করলে যেমনিভাবে নদীভাংগন স্থায়ীভাবে রোধ করা সম্ভব তেমনিভাবে বাধের উপরদিয়ে রাস্তা তৈরী করে চর অন্চলে মানুষের যোগাযোগের এক অন্যন্য ব্যবস্থা তৈর করা সম্ভব হবে।
অবকাঠামোগত ও কৌশলগত পদক্ষেপসমূহ বন্যা ও নদীভাংগনের জন্য দূর্যোগ ব্যবস্থাপায় কিছু কৌশলগত সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জনজীবনে দূর্ভোগসহ গবাদি পশু-পাখি ও ফসলের ক্ষতি কমানো সম্ভব। দূর্যোগ ব্যবস্থাপায় কৌশলগত পদক্ষেপ এগুলো হচ্ছে: (১)বন্যার পানি বৃদ্ধির আগেই বন্যার পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ তথ্য ও পদ্ধতি জনসাধারণের মাঝে দ্রুত পৌছে দিতে হবে; (২)বন্যাকবলিত এলাকাতে বন্যাপরবর্তি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জনসাধারনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে;(৩)বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে উচুকরে বন্যা-আশ্রয়কেন্দ্র তৈরী জরুরীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।এই আশ্রয়-কেন্দ্রগুলোতে বছরের অন্য সময়ে স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। তাহলে বন্যায় কবলিত শিশুদের স্কুলের পড়া-লেখা বন্ধ হবে না;(৪)বন্যা পরবর্তী চাষাবাদের জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরীতে সাহায্য করা;(৫)প্রয়োজনবোধে র্দীঘ জলাবদ্ধ এলাকাসমূহে ভাসমান সবজী চাষের জন্য কৃষককে সাহায্য করা;(৬)প্লাবন ভূমিসমূহকে ও তীব্র নদীভাংগন এলাকাসমূহকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করা এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডের চাহিদা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা (৭) সষ্টভূজ আকৃতি ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে নদীভাংগন রোধে বাঁধ নির্মান করা এবং সর্বপরি (৮)তীব্র নদীভাংগন এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে নদীভাংগন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাধ নির্মাণ করা অতি প্রয়োজন।
প্রতি বছরই বন্যা হচ্ছে, হয়েছে এবং হবে। কোনোটি হবে মাঝারি আকারের, কোনোটি ভয়াবহ। সব ধরনের বন্যার জন্যই প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। খাল-বিল ও নদীর তলদেশ গভীর খনন করলে বন্যার পানি খাল-বিল ও নদীর পানি ধরে রাখার ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তখন নদীর পানি উপচে পাড়ের দিকে ধাবিত হবে না এবং নদীর পাড় ভাংগনের ভয়াবহতা কমে আসবে। নদী ভাংগন রোধে সিমেন্টের ব্লক পদ্ধতির পরিবর্তে সষ্টভূজ আকৃতি ডিজাইনের ব্লক তৈরী করে নদীভাংগন রোধ করা এবং নদীভাংগন রোধে ফ্লাড-বেড পদ্ধতিতে বাধ নির্মাণ করে টেকস উন্নয়ন করা। বন্যা ও নদী ভাংগনের মতো দূর্যোগ ব্যবস্থাপায় সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে জনদূর্ভোগ কমানো সম্ভব হবে। অপরদিকে, খাল-বিল-নদী উদ্ধার ও খনন করে বন্যার পানি ধরে রাখতে পারলে প্রয়োজনীয় সময়ে পানি কৃষি কাজে ব্যবহার, মৎস চাষে উন্নয়ন এবং সর্বপরি পরিবেশ-প্রতিবেশের সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। দেশের প্রতিটি খাল-বিল-নদী উদ্ধার ও খনন করে করে দেশের বিভিন্ন অন্চলে নৌপথ তৈর করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে।তাছাড়া ঢাকা শহরের চারিদিকে টেকসই নৌপথ চালু করলে শহরের যানজট অর্ধেক কমে যাবে। তাই নদীগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থা ও কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নদী পরিবেষ্টিত বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্রতা দুর করা সম্ভব।
0 মন্তব্যসমূহ