দর্পণ ॥ কিছু কথা-কিছু খুশী ॥ সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

             কিছু কথা-কিছু খুশী

     আমি বাংলার--আমি ভারতের   

             সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী

সেই বছর পঁয়ষট্টি আগে। যখন ছোট ছিলাম --সবে একটু একটু বুঝতে শিখেছি। ভোট আসছে। ভোট আবার কিসে চেপে আসবে??হেঁটে! না সাইকেলে! না নদীতে নৌকো করে! একা আসবে! সাথে কতজন আসবে! কতদিন থাকবে!!বেশীদিন থাকলে তো অসুবিধা। আমার মাকে অনেক রান্না করে খাওয়াতে হবে। সে কেমন দেখতে!  সে কি খুব রাগী! তৃতীয় শ্রেণীর মাষ্টার মশায়ের মতো ছড়ি দিয়ে মারে! না বড় মাষ্টার মশায়ের মতো খুব ধীরে ধীরে কথা বলেন। কার কাছে জানতে পারবো!! ভয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। বাবা--কাকা--মামা সবাই মিলে কি সব যুক্তি করতো। আমরা ছোট বুঝতে পারতাম না। অনেকের হাতে কত রঙিন কাগজের তাড়া দেখতাম। তাতে অনেক রকম ছবি আঁকা থাকতো।-----

বাড়ি বাড়ি অচেনা কারা যেন আসতো---কাগজ দিত--বৌদের বোঝাতো --কিভাবে ছাপ দিতে হবে। ঐ কাগজগুলোতে কি লেখা কি আঁকা আছে?? দেখতে পেতাম না তো। ভাবতাম--আচ্ছা ভোটের গায়ে ছাপ দিতে হবে কেন?? ভোটকে বহুরূপী সাজাতে হবে?? আমাদের গ্রামে এক বহুরূপী আসতো ---মা কালী। পা পর্যন্ত কালো ঘন চুল। পেট পর্যন্ত একটা চওড়া লাল জিভ। রঙিন ঝলমলে পোষাক। কি সুন্দর দেখতে লাগতো। কিন্তু কথা বলতো না। আমরা ভয়ে কাছে যেতাম না। মা বাটি ভর্তি চাল দিত। তারপর চুপচাপ চলে যেতো। মাসে একবার আসতো। ভোট ও কি মাসে মাসে আসবে?? বহুরূপী তো নিজে সেজে আসে --ভোট কি নিজে সাজতে জানে না। তাকে ছাপ দিয়ে সাজাতে হবে?? আবার বলছে বাড়ির সব বড়দের যেতে হবেই। আমাদের ছোটদের নিয়ে যাবে না বলছে। আমাদের গ্রামে আমাদের বাড়ির পাশেই আমাদের ছোট স্কুলটাতে ভোট হবে। আবার বলছে --ভোট হবে। এই সবাই বলছিল ---ভোট আসছে --আবার বলছে--ভোট হবে--আবার বলছে ভোট নিতে অন‍্য ইস্কুলের মাষ্টার মশায়রা আসবে। তাঁরা স্কুলে থাকবে। একজন পুলিশ আসবে। গ্রামের লোক দু'দিন খাওয়াবে। পুলিশ কেন আসবে??ভোটকে যদি গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয় তাই?? কি সব যে বুঝতে পারতাম না।

   পরে একটু বড় হয়ে বুঝলাম--রাজ‍্য--দেশ পরিচালনার জন্য যাকে পছন্দ তার নামের পাশে যে ছবি আঁকা আছে তার উপর একটি ছাপ দিতে হবে। ---ভোটের দিন এসে গেছে। আগের দিন বাড়িতে প্রচুর আনাজ, মাছ, মশলা কিনে আনা হয়েছে। অনেকে খাবে। ইস্কুলের আশেপাশে দড়িতে রংবেরঙের পতাকা আটার আঠা দিয়ে ঝোলানো হয়েছে। পরের দিন ভোট।---দূর দূর গ্রাম থেকে কত মানুষ আসছে। আমার মামাবাড়ির সবাই এসেছে বাচ্চারা সহ। বাচ্চারা আমাদের সাথে খেলা করছে। বড়রা মুড়ি খেয়ে ইস্কুলে ছাপ দিতে গেল। ফিরে এসে চান করে ভাত খেয়ে উপরের দোতলায় ঘুমোলো। বিকেলে বাড়ি ফিরে গেল। ---বেশ কয়েক বছর পর--মায়ের সাথে --মায়ের কাপড়ের আঁচল ধরে ভয়ে ভয়ে আমি দেখতে গেলাম ভোটটা কি জিনিস। মা এক ঠাকুমার পেছনে দাঁড়ালে। হাতে একটা কি কাগজ। আমি তো পড়তে জানি। মা নিজের হাতেই রাখলে‌। আমাকে একপাশে দাঁড়াতে বললে। আমাকে ঢুকতে দিল না। আমাদের ক্লাসরুমে অচেনা তিনজন লোক--দরজায় একটি লাঠি হাতে পুলিশ না কি দারোয়ান। ঐ লোকটাই ঢুকতে দিল না। আমাদের ক্লাসরুমে আমরা ঢুকতে পারবো না!!! আমাদের মাষ্টারমশায়কে ও দেখতে পাচ্ছি না। মাষ্টারমশাই আমাকে একবার দেখতে পেলেই ঢুকতে দেবেন। কিন্তু না--বাইরে একদিকে দাঁড়িয়ে রইলাম---মুখে ঘোমটা দিয়ে গ্রামের বৌরা একদিকের দরজা দিয়ে ঢুকছে --অন‍্য দরজা দিয়ে বেরোচ্ছে। বড় বড় ছেলেরা ও তাই। মা বেরিয়ে আসতেই মায়ের আঁচলটা আবার ধরলাম। কি ভয় --ভোট যে কি বা কে জানতে পারছি না।

 যাই হোক্ দেখতে দেখতে আমি নাকি বড় হয়ে গেলাম --সেই ১৯৭৪ সাল। আমি নাকি ভোট দেবো। ভোট দেবো--সে টা আবার কি??? বন্ধুরা মিলে মুড়ি খাই--মুড়ি একে ওকে দিই। ভাত খাওয়ার সময় বাবা আমায় মাছের মাথা ভেঙে আমায় দেয়। টেনিকয়েড খেলার সময় আমরা গোল রিংটা একজন আর একজনকে দিই। ভোট দেবো। না বুঝিয়ে দিয়েছে --কিভাবে দিতে হয়। আমার সেই প্রাইমারি স্কুল --তৃতীয় শ্রেণির ঘর। মনে মনে ভাবলাম আমাদের মাষ্টার মশাইরা থাকবেন?? আসলে আমি বেশ বোকা ছিলাম বা ভোট কি? কেন দেয়? কাকে দিলে ভালো!! কিছু বুঝতাম না বা ভাবতাম না। আবার অন‍্যজন বুঝিয়ে দিত কিভাবে ছাপ দিতে হয়--কাকে দিতে হবে ---সবকিছু। আমি জিজ্ঞেস করতাম ঐ একজনকে দেবো কেন?? রঙিন কাগজে তো অনেকের নাম আছে--সবাইকে দেবো। সবাই একসাথে থাকবে। আমরা যেমন বাড়িতে কুড়িজন মানুষ তো একসাথে থাকি --খাই --একবাড়িতে ঘুমোই। বড়রাও বলে দিতেন---না একজনকেই দিতে হবে।

ভোট দিতে যাওয়ার আগে মুখস্থ করছি কোন নামের পাশে ছবিতে ছাপ দিতে হবে। যদি ভুলে যাই---কত নম্বরে আছে আঙ্গুলের গাঁটে মনে রাখতাম। সে কি চাপ!!!!কত পড়া মুখস্থ করেছি-- নামতা মুখস্থ করেছি---ইংরেজি পদ‍্য মুখস্থ করেছি---ভয় লাগে না। কিন্তু ভোটের একটা নাম মুখস্থ করতে কি কষ্ট।

----না না---অন‍্য লোকের পাছে ছাপ পড়ে যায় তার ভয়। বাবা--কাকা বলে দিয়েছেন যে। না প্রথম ভোটটা নির্বিঘ্নে দিয়ে দিলাম। ভোটের ফল বেরোনোর পর শুনলাম আমি যাকে ছাপ দিয়েছি সেই জিতেছে। বা- বা- নিশ্চিত হলাম---আমার ছাপটা কাজে লেগেছে।

---আমি আমার নাগরিকত্ব প্রমাণ করেছি। ---তারপর বেশ কয়েকটা বছর যাযাবরের মতো কলেজ -ইউনিভার্সিটি-পরীক্ষা-

ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে ভোট ভুলে গেছি। ১৯৮১ সাল ছাপ দিলাম শশ্বুরবাড়ীর লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলের ঘরে--গরমে --ভিড়ে--ঘামে চান করে একঘন্টা পর ছাপ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপর থেকেই ভোট এলেই কেমন একটা আতঙ্ক লাগতো- --ভিড়-ঠেলাঠেলি--কে আগে যাবে--ও কেন ঠেলে দিল---ধ‍্যুৎ তেরি--এ আমার সইবে না। যাবোই না ছাপ মারতে। না না সব কষ্ট ভুলে চলে যেতাম ঠিক সময়ে। তখন আমার চাকুরীস্থলের সামনে সেই প্রাইমারি স্কুলে। সেই একরকম ভিড়-- ঠেলাঠেলি --বড্ড বিরক্তিকর। 

    ক্রমশঃ বুঝতে শিখলাম ভোট মানে দলে দলে ভাগ--ভাগাভাগির অঙ্ক। তার আগে দল বেঁধে স্লোগান --মাঠভর্তি লোক--বক্তব্যের ঢেউ। গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো কিন্তু বেশ খুশি খুশি থাকে।  ভোট--রাজনীতি কি প্রথম বুঝলাম যখন আমার বয়স মাত্র বত্রিশ কি চৌত্রিশ। জানালায় ঢিল পড়লো। তারপর আরো একটু পরিস্কার হোল যখন ছেলেকে এলাকায় বৃত্তি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হোল না। তারপর আরো একটু পরিস্কার হোল যখন বিদ‍্যালয় পরিস্কার রাখার কারণে কোন একটা ব‍্যানার তুলে দিয়েছিল।সত্তর জন যোয়ান ছেলে এসে ছেলের উপর চড়াও 

হয়েছিল। আরো বুঝলাম ---মাওবাদী নামক অজ্ঞাত মানুষের হানা। না না ---নাগরিকত্ব প্রমান করেই চলেছি--ভোট এলেই ছাপ দিতে কুন্ঠা করিনি।

---২০২১ এর ভোট---প্রথম পশ্চিম মেদিনীপুর। আজ--২৭.০৩.২০২১ নাগরিকত্ব প্রমান করে এসেছি ঠিক বেলা ২.১০ এ। শুনশান চারদিক--সেই বাড়ির সামনে প্রাইমারি স্কুল---তিনজন মেয়ে ভোটকর্মী--দরজায় চারজন সেন্ট্রাল ফোর্সের চার যোয়ান ভাই। লাইন নেই---চুপচাপ নির্ভয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকা---আই কার্ড দেখানো--আঙ্গুলের টিপছাপ দেওয়া। এই যে আঙ্গুলের টিপছাপ ---কেমন যেন নিজেকে অক্ষর পরিচয়হীন মনে হয়। তাও আঙ্গুলের ছাপটাই তো নিশ্চিত "আমি"--প্রমাণ করে। 

টিপছাপ দিয়েই ভোটবোন বোতাম টেপার কামরার দিকে এগোতে নির্দেশ দিতেই এগোলাম। আবার ভ‍্যাবাচ‍্যাকা ---কোন বোতাম টিপবো???আবার ভুলে গেছি। ভালো করে পড়লাম তারপর বোতাম টিপে দিলাম। লাল আলো জ্বলে উঠল--কি রে ভুল করলাম নাকি??।জিজ্ঞেস করলাম---লাল আলো যে। বোন উত্তর দিলে দাঁড়িয়ে থাকুন--একটি শব্দ হলে বেরোবেন। একটু পরে শব্দ হোল। বাবা--রে আমার বড় ভয় করে এই ভোটের ছাপ বা বোতাম টিপতে। ---আঙ্গুলের দাগটা বারবার দেখতে থাকি আমি। বা ভোটটা আমি দিতে পেরেছি। এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ও কেমন ভয় করে। ---এ বছর ভোট দেওয়া হবে কিনা অনিশ্চিত ছিল-- চিকিৎসাজনিত ব‍্যস্ততায়। না সব ঠিক ঠিক হয়েছে। ভোটটা দেওয়ার জন‍্যই কলকাতা থেকে চলে আসা---ডাক্তারবাবুর সাবধান বানী উপেক্ষা করে স্বামীর বায়না সামলাতে ---ভোটটা দিতেই হবে।

      তবে ভোট এলে মনের ভেতর কেমন অস্থিরতা জাগে। মারামারি --দলাদলি --ভাগাভাগি---অবিশ্বাস--আড়ালে আড়ালে আলোচনা ---আরো কত কি। এই তো মাওবাদীদের হানায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন---কত মানুষের দরজায় বোমা পড়েছে --অন‍্যের দরজায় আঘাতে আমার দরজায় নান্ট-বল্টু অনায়াসে প্রবেশ করেছে। আচ্ছা এগুলো কি ভালো লাগে??? আমার মতো সবাই তো বোকা থাকলেই পারে। ভোট এলে সবাই খুব চালাক হয়ে যায়। আমি কখনো চালাক হবো না। ভোট এলেই খুঁজে বেড়াবো আমার মায়ের আঁচল। --নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার বাসনা।

---আমি-আমরা-প্রমাণ করেছি আমরা বাংলা -ভারতের নাগরিক। ভোটের পরের পরের কাহিনী--তোলা থাক্ --ভবিষ্যতের খাতায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ