কবিতা গুচ্ছ || জয়ীতা চক্রবর্তী আচার্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



ফুরিয়ে যাওয়া সময় – অন্য রূপ


সময় আজ নিজের ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে—

আয়নার ভেতর থেকে হারিয়ে গেছে মুখগুলো,

শুধু ঠান্ডা কাঁচে লেগে আছে নিঃশ্বাসের দাগ।


পায়ের নিচের ধুলো মনে করিয়ে দেয়,

এখানে একসময় বসন্ত বসে ছিলো,

পাতার উপর রোদের জল ছড়িয়ে দিয়ে।


এখন বাতাসে শুধু শুকনো শব্দ,

যেন কেউ দূর থেকে ফিসফিস করে বলছে—

ফুরিয়ে যাওয়া মানেই শেষ নয়,

কখনও কখনও এটাই শুরু।


২/ বিবর্তনের ধারাবাহিকতা


 নিজেকে আর অপরিচিত লাগে না—

শরীরের ভাঁজে, মুখের রেখায়

লুকিয়ে আছে গল্পের স্তর,

যা লিখেছে সময় নিজের কলমে।


আবেগের অগ্নি কিছুটা শান্ত,

তবু তার তাপ এখনো উষ্ণ রাখে ভেতরকার শীতলতা।

বন্ধুরা কিছু দূরে সরে গেছে,

আবার নতুন কয়েকজন এসে বসেছে হৃদয়ের বারান্দায়।


যৌবনের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে

বুদ্ধির সেতু জুড়ে গেছে,

ভুলের সংখ্যা কমেছে

কিন্তু প্রজ্ঞার ওজন বেড়েছে বহুগুণ।


চল্লিশ মানে আয়নায় নিজেকে

পূর্বের তুলনায় গভীরভাবে দেখা,

মানুষের মুখোশ ভেদ করে

আসল আলো-অন্ধকার চিনে নেওয়া।

এ বয়সে জীবন

এক বিস্তৃত নদী—

যেখানে প্রতিটি ঢেউ

পূর্বের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে

ভবিষ্যতের তীরে এগিয়ে যায়।



৩/ শিব শক্তি


রুদ্রাক্ষের মালা ঝরে পড়ছে অগ্নির মুখে,

শ্মশান বাতাসে দুলছে অস্থি-ঘণ্টা।

শিবের গলায় ঝোলানো সময়ের সাপ

শক্তির পদতলে ছুঁয়ে দিচ্ছে রক্তের রেখা।


কালো চাঁদের নিচে গোপন যজ্ঞমঞ্চ,

মাটিতে আঁকা মণ্ডল—

প্রতিটি রেখা একেকটি জন্মের প্রতিশ্রুতি।

শক্তির কপালে লেপা সিঁদুর

আসলে মৃত্যুর সীলমোহর।

শিব হাসছে—

তার তৃতীয় নয়নে জ্বলে উঠেছে সর্বনাশের স্ফুলিঙ্গ।

শক্তি তখন আঙুলে ধরে

প্রথম শব্দ, প্রথম ধ্বনি, প্রথম জীবন।


যখন তারা মিলিত হয়—

অগ্নি কালো হয়ে যায়, জল লাল হয়ে ওঠে,

আর ব্রহ্মাণ্ড কেঁপে ওঠে

নিজের প্রথম ও শেষ নিঃশ্বাসে।



৪/ স্বপ্নের দূরত্ব রাতের অভিসারে


রাত যেন এক দীর্ঘ সেতু—

দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আমি আর আমার স্বপ্ন,

মাঝখানে ঝুলে আছে অসংখ্য অন্ধকারের তার।


চাঁদের আলো নদীর মতো বয়ে যায়,

কিন্তু তীর ছুঁতে পারে না,

স্বপ্নের চোখে জমে থাকা সেই প্রতিশ্রুতিগুলো

ধীরে ধীরে ধুলোয় পরিণত হয়।

রাতের অভিসারে আমি হেঁটে যাই—

এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত,

মনে হয়, এই যাত্রা কেবলই

এক অবিরাম অসম্পূর্ণতার দিকে।


তবু, দূরত্বের ভেতর লুকানো

এক অদ্ভুত সান্ত্বনা থাকে—

যেন স্বপ্ন না ছুঁতে পারার মধ্যেই

তার সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।



৫/ খিদের গন্ধে ছায়াদের রূপক


খিদের গন্ধ উঠলেই প্রথমে হালকা কুয়াশার মতো ছায়ারা জেগে ওঠে। তারা আসে চুপচাপ, শব্দহীন, যেন মাটির ভেতর থেকে ভাঙা হাড়ের মতো গজিয়ে উঠছে। তাদের হাত বাড়ানো থাকে, কিন্তু সেই তালুতে কিছুই নেই—শুধু শূন্য বাতাস। চুলোর ধোঁয়া পাক খেতে খেতে তাদের মুখের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, আর তারা গন্ধে খুঁজে ফেরে কোনো হারানো আকার, কোনো পুরনো তৃপ্তি। চোখের গর্তে জমে থাকে অদ্ভুত এক শূন্যতা, যেখানে আলো ঢোকে না, তবু গন্ধ ঢুকে যায়। গন্ধ যত ঘন হতে থাকে, ছায়ারা তত কাছে আসে, তত অস্থির হয়, আমার শ্বাসে মিশে যায় তাদের ক্ষুধা। আর তখন হঠাৎ বুঝতে পারি—এই ছায়ারা বাইরে থেকে আসেনি, তারা অনেকদিন ধরেই আমার ভেতরে বাস করছে, আমারই অচেনা অবয়ব হয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ