পোস্ট বার দেখা হয়েছে
সকালের কোমল রোদের ছায়া পাহাড়ের কাঁধে আলতো আঁচড় কেটে যাচ্ছে। সেই আলো যেন ঘুম ভাঙা শিশুর নিঃশ্বাসের মতো, নরম ও নিঃশব্দ। সবুজে ঢাকা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটে চলেছে অনিমেষ আর নীলা—এক নিঃশব্দ যাত্রায়, যেখানে শব্দের প্রয়োজন হয় না, কেবল অনুভবই যথেষ্ট। বাতাসে এক ধরনের অনুচ্চারিত কাব্যিকতা ঘোরাফেরা করছে—জ্যোৎস্নার মতো হিমেল, নদীর মতো নরম, আর পাহাড়ের মতো নিরাবেগ অথচ গভীর। চারপাশে গাছপালার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো ছিটকে পড়ছে তাদের মুখে—কখনো রৌদ্র, কখনো ছায়া। তারা এসেছে এক নির্জন পাহাড়ি গ্রামে, দার্জিলিং-এর উপকণ্ঠে। কলেজের টানা ব্যস্ততা ও শহরের কোলাহলের বাইরে এই কয়েক দিনের ছুটিতে তারা খুঁজে নিচ্ছে প্রশান্তি—এবং, হয়তো নিজেদেরও। আজ ভোরে সূর্যোদয়ের ঠিক পরেই শুরু হয়েছে তাদের ট্রেকিং। গন্তব্য—একটি অজানা জলপ্রপাত, যার অবস্থান কেবল জানা আছে গাছেদের কানে, ঝরনা গান গাওয়া বাতাসের মাঝে।নীলার পা থেমে যায় বারবার। পথের ধারে ফুটে থাকা একেকটি বুনো ফুলের দিকে সে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ হয়ে, কখনো ক্যামেরায় ছবি তোলে পাতার ওপরে জমে থাকা শিশিরবিন্দুর। তার চোখে যেন আছে প্রকৃতিকে পড়ে নেওয়ার এক নিজস্ব ভাষা। অনিমেষ তখন থেমে যায়, তার দিকে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দ বিস্ময়ে, তার চোখে একরাশ ভালবাসা আর মুগ্ধতা। যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসে সে অনুভব করে—ভাষাহীন এই অনুভূতির নামই ভালোবাসা।
— “তুই এত চুপচাপ কেন রে?” নীলা হেসে বলে ওঠে হঠাৎ, তার ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়ে রৌদ্রছায়ার খেলা।
— “তোর পাশে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ হারিয়ে ফেলি… ভালো লাগার তো ভাষা হয় না,” অনিমেষের গলায় ভিজে বিষণ্ণতা, তবুও শান্ত। নীলা কিছু বলে না, শুধু একটুখানি হেসে আবার হাঁটা শুরু করে। তার চুলে খেলে যায় পাহাড়ি হাওয়া, যেন বুনো লতার মতো। অনিমেষ তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে—এইসব দৃশ্য সে ধরে রাখতে চায় হৃদয়ের গোপন খামে। পথে কিছু কিছু খাঁজে জমে থাকা জল, মাঝে মাঝে পাথরের গা বেয়ে নেমে আসা সরু ঝরনা। হঠাৎ এক পিচ্ছিল পাথরে পা হড়কে যায় নীলার—তার শরীর ঝুঁকে আসে সামনের দিকে, আর অনিমেষ এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে। একটি মুহূর্ত থমকে যায়, শুধু চোখে চোখ পড়ে দু’জনের। সেই চোখের গভীরে যেন একটি নিঃশব্দ মহাকাব্য লেখা হয়ে যায়।
— “ধরতে না পারলে তো পড়েই যেতাম,” বলে ওঠে নীলা, ঠোঁটে অভিমান মেশানো এক হাসি।
— “আমি তোকে কখনো পড়ে যেতে দেব না, নীলা। কোনওদিন না,” অনিমেষের গলায় ধ্বনিত হয় এক গভীর প্রতিশ্রুতি—অদৃশ্য, কিন্তু অটুট।
চুপচাপ কিছুক্ষণ হেঁটে চলে তারা। দুজনেই কিছু বলে না, কিন্তু বাতাস যেন ভরাট হয়ে থাকে অজস্র অনুভবে। হঠাৎ করে একটি বাঁশবনের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা বাতাসের ছায়ায় নীলা বলে ওঠে—
— “জানো অনিমেষ, ছোটবেলায় ভাবতাম ভালোবাসা মানে বুঝি রোজ বলা ‘ভালোবাসি’। এখন বুঝি, ভালোবাসা অনেকটা এই পথের মতো… সবসময় সরল নয়, কখনো পিচ্ছিল, কখনো গাছপালায় ঢেকে থাকা, কিন্তু পাশে কেউ থাকলে পথটাও সুন্দর হয়ে ওঠে।”
অনিমেষ হেসে বলে, “তুই যে এমন কথাও বলতে পারিস, ভাবি নি।”
— “আর তুই ভাবিস অনেক কিছু, বলিস কম,” নীলা মুচকি হাসে।
এভাবে কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে যায় এমন এক জায়গায়, যেখানে গাছেরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে, যেন পাহারার মতন। দূর থেকে ভেসে আসে জলপ্রপাতের আওয়াজ—তীব্র নয়, বরং স্বপ্নের মতো মৃদু এক ডাক। চারপাশে পাখির ডাক, পাতার কচকচ শব্দ, আর কিছু নাম না জানা গন্ধ—মিশে আছে এক রহস্যময় আবেশে। অবশেষে তারা পৌঁছে যায় সেই জলপ্রপাতের ধারে। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে স্ফটিকস্বচ্ছ জলধারা, তার প্রতিটি ফোঁটায় খেলে যায় আলো—রংধনুর সাত রঙের ছায়া। চারপাশে কুয়াশা ছেয়ে রয়েছে, যেন কোনো পরী এসে লুকিয়ে রেখেছে এই জায়গাটাকে মানুষের চোখ থেকে। নীলা ধীরে জলে পা ডুবিয়ে দেয়। গা ছমছমে ঠান্ডায় কেঁপে ওঠে, কিন্তু মুখে এক প্রশান্ত হাসি। অনিমেষ পাশে বসে তাকিয়ে থাকে—তার মনে হয়, এই মুহূর্তটা সে সারা জীবনের জন্য ধরে রাখতে চায়।
— “নীলা… তোকে অনেকদিন ধরেই ভালোবাসি। আজ এই পাহাড়, আকাশ, জল, কুয়াশা—সবাই সাক্ষী হয়ে থাকুক,” অনিমেষ বলে ওঠে কাঁপা কণ্ঠে। নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার দৃষ্টি জলের দিকে, যেন নিজের মনের গভীরতা পরখ করছে। তারপর ধীরে বলে—
— “তোর চোখে সব কথা আমি অনেক আগেই পড়ে ফেলেছি, অনিমেষ। আমিও তোকে ভালোবাসি। নিঃশব্দে, নিরালায়।” সেই মুহূর্তে, প্রকৃতি থেমে যায়। বাতাস থেমে দাঁড়ায়, পাখিরা নীরব হয়। কেবল হৃদয়ের স্পন্দনে বাজে এক অব্যক্ত সুর। ধুপছায়ার পাহাড়ি পথে লেখা হয়ে যায় তাদের প্রেমের প্রথম পঙ্ক্তি—নিস্তব্ধ, অথচ উজ্জ্বল, স্থায়ী।
0 মন্তব্যসমূহ