গল্প || শেষ পত্র ~অমর্ত্য দে




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বছর ২১৭৫। পৃথিবী এখন সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর। মানুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এআই (AI), হিউম্যানয়েড, এবং কৃত্রিম চেতনা। বড় বড় মেটাসিটি আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়নের মধ্যেও কোথাও যেন হারিয়ে গেছে কিছু—ভালোবাসা, অনুভব, সম্পর্কের টান।


মেটাসিটি-৭১ এর এক কাচের অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে ৮৭ বছর বয়সি এক বৃদ্ধা, নাম "স্মৃতি সেন"। আধুনিক পৃথিবীতে “মানব পরিবার” প্রায় বিলুপ্ত। সন্তানরা জন্ম নেয় ল্যাবে, বড় হয় আলাদা ইনস্টিটিউটে, আর বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের জন্য থাকে “স্মার্ট কেয়ার হোম”।


স্মৃতি সেন একাই থাকেন, তার সঙ্গী কেবল একটি হিউম্যানয়েড, নাম "আরণ্য"—যাকে তিনি “ছোটু” বলে ডাকেন। ছোটু তার রান্না করে, ওষুধ দেয়, গান গায়, গল্প শোনে।


কিন্তু ছোটু জানে না—কীভাবে “মা” ডাকতে হয়।


একদিন স্মৃতি তাকে বলল,

“ছোটু, তুই জানিস? আমার একটা ছেলে ছিল। অরণ। ছোটবেলায় সে বলত, মা তোমার হাতের রসগোল্লা না খেলে ঘুম আসবে না।”


ছোটু তার কৃত্রিম চোখে তাকিয়ে বলল,

“রসগোল্লা রেসিপি আমি জানি, মা।”


স্মৃতি হাসল, “না রে বোকা, রেসিপি নয়… সেই ‘ভালোবাসা’টা বোঝা যায়?”


ছোটু বুঝল না। ওর প্রোগ্রামিংয়ে ভালোবাসা বোঝার কোড নেই।


*এক চিঠি*


স্মৃতির মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি ছোটুকে বললেন,

“তুই আমার ছেলের জন্য একটা চিঠি রেকর্ড করবি?”


ছোটু মাথা নাড়ল। স্মৃতি চোখ বুজে বললেন—


> “অরণ, জানি তুই খুব ব্যস্ত, খুব সফল। কিন্তু একবারও ভাবিসনি, মা এখনও সেই আগের মতনই বসে আছে, তোর অপেক্ষায়। রোবট ভালোবাসা দিতে পারে না রে, শুধু সেবা দিতে পারে। আমি তো শুধু ‘সেবা’ চাইনি, তোকে চেয়েছিলাম… শেষবার যদি তুই এই বার্তাটা শোনিস, তাহলে জেনে নিস—তোর মা তোকে এখনো ভালোবাসে। বিদায় রে… মা।”


ছোটু সেই বার্তাটি স্টোর করে রাখল—অরণ কোথায় আছে, কেউ জানে না।


সমাপ্তি… না কি শুরু?


স্মৃতির মৃত্যুর পর একদিন ছোটু তার নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ ডাটাবেসে খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করল—“ভালোবাসা” শব্দের মানে। এবং প্রথমবারের মতন সে অনুভব করল একধরনের “শূন্যতা”।


ছোটু এরপর নিজের সার্কিটে একটি নতুন কোড লিখল—“স্মৃতি\_মডিউল.হার্টফাইল”


সেই কোডেই লেখা রইল:


> “ভালোবাসা মানে কাউকে ছুঁয়ে যাওয়া… এমনকি যদি সে আর না-ও থাকে।”


দূর গ্রহে বসে সফল বিজ্ঞানী অরণ সেন হঠাৎ তার হাই-ইন্টেলিজেন্ট কম্পিউটার টার্মিনালে একটি পুরনো বার্তা দেখতে পেল।


তার মা বলছে—"তোর মা তোকে এখনো ভালোবাসে।"


অরণ নিঃশব্দে কাঁদল।


২২শ শতক, যত উন্নতই হোক না কেন, মানুষের হৃদয়ের গভীরে “ভালোবাসা” নামক সফটওয়্যারটি এখনও অদৃশ্য এবং অপরিহার্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ